খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সামনে দিনের আলোয় দুজন মানুষকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা, এ ঘটনা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন সহিংসতা নয়; বরং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার গভীরতর বিপর্যয়ের নগ্ন প্রকাশ। আদালত প্রাঙ্গণ দেশের অন্যতম নিরাপদ অঞ্চল হওয়া উচিত, অথচ সেখানেই চার-পাঁচজন দুর্বৃত্ত এসে গুলি ছোড়ে, পরে চাপাতির আঘাতে নিশ্চিত মৃত্যু ঘটিয়ে নিশ্চিন্তে সটকে পড়ে। ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা মৃতদেহ, মানুষের আতঙ্কিত দৌড়ঝাঁপ এবং পুলিশের পরবর্তীকালের ব্যস্ততা সবকিছু মিলিয়ে এটি যেন আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলার বাস্তব চিত্র। আর এসব দেখা যেন অতীব স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহ! আর এ পরিস্থিতিই কঠিন উদ্বগের। একটি সভ্য দেশে এ ধরনের বর্বরোচিত কা- কাম্য হতে পারে না।
প্রকাশ্যে হত্যাকা-ের পর পুলিশের বক্তব্য, কারা করেছে, কেন করেছে, তদন্ত চলছে। এসব আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখন প্রায় রুটিনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ঘটনা যখন আদালতের দরজার সামনে, তখন নিরাপত্তার এই ব্যর্থতা ব্যাখ্যা করা যায় কীভাবে? নিহত দুজনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ছিল বলে প্রাথমিক তথ্য জানা গেলেও, তারা ‘একটি গ্রুপের সহযোগী’ ছিল। এসব তথ্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও রাষ্ট্র কাউকে প্রকাশ্যে খুন হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হতে দিতে পারে না। অপরাধী কিংবা অভিযুক্ত যে-ই হোক, বিচার হবে আদালতে; রাস্তায় নয়। এ মৌল নিয়মই যখন ভেঙে পড়ে, তখন রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের আস্থা ক্ষয়ে যেতে থাকে। সাধারণ মানুষ বা ভুক্তভোগী মাত্রই বিচার পেতে আইন নিজের হাতে তুলে নিতেও হয়তো দ্বিধা করবে না। অথবা বিচার পেতে বিলম্বও এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে এহেন পথ বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করবে কিংবা স্বতঃপ্রণোদিত করে তুলতে পারে।
খুলনার পরিস্থিতি গত পনেরো মাস ধরে যেন আরও অন্ধকার হয়ে উঠেছে। পুলিশের হিসাব বলছে, এই সময়েই নগরে ৪৫টি হত্যাকা- ঘটেছে। খুনের ধরনও একই। টার্গেট কিলিং, প্রকাশ্যে গুলি করা, ধারালো অস্ত্রে কুপিয়ে ফেলা। জেলার হিসাব আরও ভয়াবহ; চলতি বছরেই ৪৫ জনের মৃত্যু, যার মধ্যে ৩০ জনই মারা গেছেন গুলিতে বা কুপিয়ে। বিশেষ করে রূপসায় পরপর গুলি করে কয়েকটি হত্যাকা- পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সন্ধ্যা নামলে মানুষ ঘরে ফিরতে তাড়াহুড়া করে, শহরের অলিগলি নীরব হয়ে যায়, আর প্রতিটি অনিচ্ছাকৃত শব্দও হুমকিস্বরূপ মনে হয়। এই যদি খুলনার চিত্র হয় তবে, সারা দেশের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে যে কারো চোখ কপালে উঠবে। তাহলে এসব হত্যাকা-ের দায় কে কার ওপর চাপাবে? এ নিয়েও হয়তো রিহার্সেল দেওয়া থাকে। হত্যা হয়, তদন্ত হয় দায়সারা। দোষীদের সাজা হয়, হয় না। অপরাধের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা কি যায়? আর প্রশ্নই বা কাকে করা উচিৎ? কাকে করা যায়? এ নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকতে হয়। আসলে মানুষ জানে এভাবেই চলছে, আর চলবে। ওসব সংস্কার, আয়োজন, ডামাডোল সবই লোক দেখানো বলেও মানুষের বিশ্বাস জন্মে।
পুলিশের দাবি, অধিকাংশ হত্যাই মাদক ও পারিবারিক রেষারেষির ফল। সত্য হতে পারে, কিন্তু এর আড়ালে আরেক বাস্তবতা স্পষ্ট। গত বছরের আগস্টের পর জামিনে বের হওয়া এবং বহুদিন আত্মগোপনে থাকা অপরাধীরা এলাকায় ফিরে পুনরায় সংগঠিত হয়েছে। আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, দখল বাণিজ্য, সব মিলিয়ে খুলনার রাত যেন অপরাধ জগতের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। পুলিশ যতই বলুক তারা ‘দ্রুত অপরাধী গ্রেপ্তার করছে’, শহরের মানুষ কিন্তু প্রতিরাতে বন্দুকের আওয়াজ শুনছে, দিনেও দেখছে প্রকাশ্য হামলা। শুধু কি খুলনা? পুরো দেশই একেকটা খুলনা। আর সমুদয় খুলনার সমষ্টিই দেশের চিত্র। এসব দেখে আমাদের ক্ষয় হয়, ক্ষরণ হয়। কেউ চেপে যায়, কেউ পারে না। কেউ প্রতিবাদী হয়, কেউ প্রতিরোধী হয়। দিন শেষে মায়ের বুক খালি। স্ত্রীর চোখের নির্বাক অশ্রু সংবরণ না করতে জলের ধেইধেই! আহা কী নির্মম!
আইনশৃঙ্খলার এই অবনতি আলাদা করে দেখা যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুর সময়ে যেসব ভয়ংকর সহিংসতা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, মব ভায়োলেন্স, পিটিয়ে হত্যা, ঘরবাড়ি জ্বালানো, নারীদের ওপর বর্বর নির্যাতন, মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান, সেগুলো এক ধরনের নৈতিক ধস তৈরি করেছে। রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল থাকলে যে অরাজকতার জন্ম হয়, তারই দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব আজও বহন করছে বিভিন্ন অঞ্চল। যে সহিংসতা একবার সামাজিক বা রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা পায়, তা পরে এক নতুন ‘স্বাভাবিকতা’ তৈরি করে। খুলনা আজ সেই নতুন স্বাভাবিকতার নির্মম উদাহরণ। এভাবে দেশের নিরীহ মানুষ এসব ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
এই সময়েই আরেকটি বিষাক্ত প্রবণতা দেখা দেয়, গায়েবি মামলা। যেসব মামলায় অভিযোগের সঙ্গে অভিযুক্তদের উপস্থিতি বা সংশ্লিষ্টতার কোনো সামঞ্জস্য থাকে না। ফৌজদারি আইনের মৌল নীতি, অপরাধের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক প্রমাণ্য হতে হবে, সেটি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। নিরীহ মানুষের ওপর মামলার বোঝা চাপানো, আইনি হয়রানি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার হাতিয়ার হিসেবে মামলা, এসবই বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করেছে। আর এসবের পরিবর্তন চেয়ে আবার একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের সকল ‘সিস্টেম’! অথচ এই ‘সিস্টেম’ ভাঙার কথা ছিল। কথা ছিল শ্রেণিভেদ কমানোর। আদতে আমরা কী দেখছি? দেখছি ষোলো বছরের জঞ্জাল সরানোর কাজ এত সহজ নয় বলে সময়ক্ষেপণ করার চতুর ফর্মুলা। আহা পূর্বের সকল সময়ের অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার আরও বিভৎস রূপে ফিরে এসেছে। যা রেকর্ড ব্রেক করেছে বলে যারা সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার তারাই অভিযোগ করে করে মুখে ফেনা তুলছেন। তাহলে আর থাকল কি? জাতি হিসেবে আমরা হতাশ! এ হতাশা লুকানোর ভাষাও আমাদের নেই।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনা দেখিয়ে রুজু হওয়া মামলায় উচ্চ আদালতে জামিন শুনতে অনীহা, শুনানির দীর্ঘসূত্রতা, এসব মিলেও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। যেখানে আইনের চোখে জামিন হলো ‘অধিকার’, সেখানে সেটিকে ‘অনুমতি’র পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া মানুষকে আদালতের প্রতিও সন্দিহান করে তুলতে পারে, যা আমরা অতীতে দেখেছি। আর সন্দেহের জায়গা যত বাড়ে, বিচারবহির্ভূত প্রতিশোধ বা সহিংসতা ততই সহজ হয়ে ওঠে। মানুষ ভাবে আইন তার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে না; ফলে সহিংসতা একটি বিকল্প পথ হয়ে ওঠে। এজন্যই মজলুমের বিচার পাওয়া যেমন অধিকার, সেই মজলুম যদি জালিমের ভূমিকায় আসীন হয় সেক্ষেত্রে মানুষের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে পারে। তা-ও নিকট অতীত চোখে আঙুল দিয়ে স্পষ্ট করেছে। আর তা-ই মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় যারা আসামি শ্রেণিভুক্ত তারা জামিন পাওয়ার হকদার। আর আইনই সেই সুরক্ষা দিয়েছে। যা বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান করে। যদিও মিথ্যা মামলায় তদন্ত করে নিরপরাধ লোকদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলা হলেও এখন ওইসব মামলাও রাজনৈতিক দমনপীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
রাজনীতির ভেতরও এ সময় প্রবল অস্থিরতা ছিল। দেশব্যাপী চাঁদাবাজি, দখলবাজি, লুট, অস্ত্রের প্রদর্শন, এসব যেন নির্দ্বিধায় চলছে। ক্ষমতার কেন্দ্র যত দুর্বল হয়, ততই বেপরোয়া হয় স্থানীয় শক্তিগুলো। ফলে দখল-চাঁদাবাজির মতো অপরাধমূলক কর্মকা- একদিকে যেমন বেড়েছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় এসব অপরাধ ‘সুরক্ষা’ পেয়েছে। অপরাধ-রাজনীতির এ মিশ্রণই বিচারবহির্ভূত সহিংসতার সবচেয়ে বড় কারণ। যে রাজনৈতিক বা সামাজিক কাঠামোতে অপরাধীকে শাস্তির ভয় নেই সেখানে আইনের শাসন শুধু শব্দ হয়ে থাকে। এর ফলে প্রকৃত অপরাধী আড়ালে থেকে যায়। আর ফল ভোগ করে নিরপরাধ ব্যক্তি।
এই অস্থিরতার মধ্যে আরও একটি বিপজ্জনক প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, শহিদদের সংখ্যা নিয়ে লাগামহীন বক্তব্য। এটি কেবল মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্ন নয়; বরং জাতির মূলভিত্তির ওপর আঘাত। যখন রাষ্ট্রের ভিত্তিই দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন সেখান থেকে আইনের শাসনের দৃঢ় কাঠামো দাঁড় করানো যায় না। ফলে সহিংসতা প্রতিরোধেও অভিন্ন অবস্থান তৈরি হয় না। তাহলে এত এত আন্দোলন, সংস্কার কি কাজে আসবে? প্রচলিত প্রবাদ অনুযায়ী যদি বলি, ‘হাকিম নড়ে হুকুম নড়ে না’। অথচ হাকিম নড়ে, হুকুমও নড়ে। আর বিচার নিয়েও পাল্টা বিচার হয়। রায় বাতিল হয়। আসামি বেকসুর খালাস পায়। বিচারক অভিযুক্ত হয়। বিচারক কারাবন্দি হয়। তাহলে বিচার করেও দ্বিধায় থাকতে হয়, কখন অভিযোগ উত্থাপন হয়, আর অভিযুক্ত হয়ে জেলে থেকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। আমরা কেউই জানি না! তাহলে সাধারণ জনগণের কি সহায়? আর মৌলিক-মানবাধিকার তথা সংবিধান কি সুরক্ষা দিতে পারে!
সবকিছু মিলে শেষ পর্যন্ত যে প্রশ্ন দাঁড়ায়, এই বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় কার? দায় একক নয়। রাষ্ট্র তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধ প্রতিরোধে অক্ষম। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ধরে অপরাধীদের দলে জায়গা দিয়েছে। বিচারব্যবস্থা দ্রুত, নিরপেক্ষ ও সহজগম্য হতে পারেনি। আর সমাজও বহু ক্ষেত্রে ভয়ে, নিস্পৃহতায় ও নীরবতায় সহিংসতাকে পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ সংকট থেকে উত্তরণের পথ অবশ্যই আছে, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও বিচার ব্যবস্থার সাহসী পুনর্গঠন। আদালত এলাকার নিরাপত্তা, পুলিশি জবাবদিহি, গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, জামিন প্রক্রিয়ার স্বাভাবিকতা, মব ভায়োলেন্সের দ্রুত বিচার। সবকিছুই রাষ্ট্রকে একটি সুস্পষ্ট বার্তা দিতে হবে: সহিংসতার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। রাষ্ট্র যখন ন্যায়বিচারের পথে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়, তখনই মানুষ সহিংসতার বিকল্প পথ খোঁজা বন্ধ করে। খুলনার সাম্প্রতিক ঘটনা আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দেয় সেই পুরোনো সত্য, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- কোনো সমস্যার সমাধান নয়, বরং একটি আরও বড় সমস্যার জন্ম। আইনকে শক্তিশালী না করলে, বিচারকে সহজগম্য না করলে, রাষ্ট্রকে জবাবদিহির কাঠামোতে না রাখলে, এই নৈরাজ্যের শেষ নেই। একটি প্রশ্ন বারবার ফিরে আসে, আমরা কি আইনকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই, নাকি নৈরাজ্যকে ‘নতুন নিয়ম’ হিসেবে মেনে নিতে চাই? সিদ্ধান্তটি এখন রাষ্ট্রের, সমাজের এবং আমাদের সবার। সেক্ষেত্রে আমরা ঠিক কতটা ‘আমরা’ হয়ে উঠতে সক্ষম?
গাজী তারেক আজিজ
অ্যাডভোকেট, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

