আজকের দিনে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমরা কোনো না কোনো স্ক্রিনের সামনে বসে থাকি। মোবাইল, কম্পিউটার, ট্যাবলেট, টেলিভিশনÑ এসব ডিভাইস আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু এই স্ক্রিনগুলো থেকে বেরিয়ে আসা নীল আলো কি শুধু আমাদের চোখের ক্ষতি করছে, নাকি আমাদের মনের কল্পনা শক্তিও কমিয়ে দিচ্ছে? একবার ভেবে দেখা যাক, দিনে কতক্ষণ আমরা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি? সকালে ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল চেক করা, অফিসে কম্পিউটারে কাজ করা, দুপুরে খাবার সময় ফোন স্ক্রল করা, রাতে সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ দেখাÑ এভাবে হিসাব করলে দেখা যায় প্রায় ৮-১২ ঘণ্টা স্ক্রিনের সামনেই কেটে যায়। আগের প্রজন্মের মানুষেরাÑ বই পড়তেন, গল্প শুনতেন, নিজেরা গল্প বানাতেন, প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে সময় কাটাতেন। তাদের মন ছিল উর্বর মাঠের মতো, যেখানে কল্পনার বীজ সহজেই অঙ্কুরিত হতো। কিন্তু এখন? আমরা সবকিছু রেডিমেড পেয়ে যাচ্ছি। ভাবনার জায়গাটা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। স্ক্রিনের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ জ্বালা করে, মাথা ব্যথা হয়, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। যখন আমাদের চোখ ক্লান্ত হয়, তখন আমাদের মস্তিষ্কও ক্লান্ত হয়। স্ক্রিনের নীল আলো আমাদের মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণ কমিয়ে দেয়, যার ফলে ঘুমের সমস্যা হয়। ঘুম ঠিকমতো না হলে পরদিন মাথা ঝিমঝিম করে, মনোযোগ কমে যায়। আর মনোযোগ না থাকলে নতুন কিছু ভাবা বা কল্পনা করার শক্তি কোথা থেকে আসবে? গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে ৬ ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন টাইম মানুষের সৃজনশীলতা এবং কল্পনা শক্তি কমিয়ে দেয়। কল্পনা শক্তি মানে হলো নতুন চিন্তা, নতুন ছবি, নতুন পরিস্থিতি মনে মনে তৈরি করার ক্ষমতা। শিশুরা যখন খেলনা নিয়ে খেলে, তখন তারা নিজেদের মতো করে গল্প বানায়। একটা কাঠি হয়ে যায় তলোয়ার, একটা বাক্স হয়ে যায় মহাকাশযান। এই কল্পনা শক্তিই তাদের সৃজনশীল হতে শেখায়। কিন্তু যখন একটা শিশু ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইউটিউবে কার্টুন দেখে বা গেম খেলে, তখন তার মস্তিষ্ক শুধু রিসিভ মোডে থাকে। তাকে নিজে কিছু ভাবতে হয় না, সবকিছু তৈরি করে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে সে নিজে কিছু কল্পনা করার অভ্যাস হারিয়ে ফেলে। বড়দের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। আমরা যখন ক্রমাগত সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করি, অন্যদের পোস্ট দেখি, ভিডিও দেখি, তখন আমাদের মন নিজে কিছু সৃষ্টি করার সুযোগ পায় না। আমরা হয়ে উঠি কনটেন্টের দর্শক, আবিষ্কারক নই। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। আপনি যখন ছোট ছিলেন, হয়তো রাতে দাদা-দাদি বা বাবা-মায়ের কাছে গল্প শুনতেন।
তারা যখন বলতেন, ‘এক রাজা ছিল,’ তখন আপনার মনে নিজে থেকেই সেই রাজার ছবি তৈরি হতো। তার পোশাক কেমন, রাজপ্রাসাদ কেমন দেখতেÑ সবকিছু আপনার কল্পনায় জীবন্ত হয়ে উঠতো। কিন্তু এখন শিশুরা রাজার গল্প শোনে না, তারা ডিজনির মুভি দেখে। সেখানে রাজা, রাজপ্রাসাদ, সবকিছু রেডিমেড দেওয়া থাকে। ফলে তাদের মনে নিজস্ব ছবি তৈরির প্রয়োজন হয় না। এই পার্থক্যটা ছোট মনে হলেও, এর প্রভাব ব্যাপক। আবার অফিসের কথা ভাবুন। আগে মিটিংয়ে বসে মানুষ আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করত, হোয়াইট বোর্ডে ছবি এঁকে নতুন পরিকল্পনা করত। আর এখন? পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দেখা হয়, টেমপ্লেট ব্যবহার করা হয়। সৃজনশীলতার জায়গা কমে গেছে অনেকখানি। স্ক্রিন থেকে যে নীল আলো বের হয়, সেটা বিশেষভাবে ক্ষতিকর। এটা আমাদের চোখের রেটিনা পর্যন্ত পৌঁছে এবং সেখানে ক্ষতি করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এটা দৃষ্টিশক্তি কমিয়ে দিতে পারে। আমাদের শরীর নীল আলো দেখে বুঝে নেয় যে এখনো দিন আছে, তাই মেলাটোনিন হরমোন তৈরি করে না। ফলে রাতে ঘুম আসে না। আর ঘুমের অভাব মস্তিষ্কের চিন্তার দক্ষতা, কল্পনা শক্তি কমিয়ে দেয়। গবেষকরা দেখেছেন, যারা ঘুমানোর আগে দুই ঘণ্টা স্ক্রিন দেখেন না, তাদের ঘুম ভালো হয় এবং পরদিন তারা বেশি সৃজনশীল কাজ করতে পারেন। বর্তমান প্রজন্মের শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে উদ্বেগজনক। ছোট বয়স থেকেই তারা ট্যাবলেট আর স্মার্টফোনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। তিন-চার বছরের বাচ্চাদের হাতে মোবাইল ফোন দেওয়া হচ্ছে শান্ত রাখার জন্য। কিন্তু এই বয়সটা হলো মস্তিষ্কের বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে শিশুদের চারপাশ পর্যবেক্ষণ করা, হাতে কলমে শেখা, খেলা, কল্পনা করাÑ এসব খুব জরুরি।
স্ক্রিন টাইম এসব সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে। একটা গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু দিনে দুই ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন দেখে, তাদের ভাষা দক্ষতা, সমস্যা সমাধান ক্ষমতা এবং কল্পনা শক্তি কম থাকে। তারা খেলার সময় নতুন গল্প বা পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে না, তাদের মনে আটকে থাকে ভিডিওতে দেখা ছবি। আজকের তরুণ প্রজন্ম, যাদের বলা হয় জেনারেশন জেড, তারা জন্ম থেকেই ডিজিটাল দুনিয়ার মধ্যে বড় হচ্ছে। তাদের কাছে বই পড়ার চেয়ে ভিডিও দেখা সহজ, চিন্তা না করে গুগল সার্চ করে। ছাত্র-ছাত্রীদের গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, জটিল সমস্যা নিয়ে ভাবতে চায় না, সবকিছুতে তারা শর্টকাট খোঁজে। এর কারণ হলো ডিজিটাল মিডিয়া তাদের মনোযোগের সময়সীমা কমিয়ে দিয়েছে। টিকটক, ইনস্টাগ্রাম রিলস, ইউটিউব শর্টসÑ এসব ১৫-৬০ সেকেন্ডের ভিডিও মস্তিষ্ককে এমন প্রশিক্ষণ দিচ্ছে যে, সে দীর্ঘ সময় একটা বিষয়ে মনোযোগ দিতেই পারছে না। আর যখন মনোযোগ দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখা যায় না, তখন গভীর চিন্তা বা সৃজনশীল কল্পনা করাও সম্ভব হয় না। কল্পনা করতে গেলে সময় লাগে, ধৈর্য লাগে, মানসিক স্থিরতা লাগেÑ যা স্ক্রিন টাইম আমাদের থেকে কেড়ে নিচ্ছে।
অতিরিক্ত স্ক্রিন ব্যবহারকারীদের সামাজিক দক্ষতা এবং সহানুভূতি কম থাকে। পরিবারের মধ্যেও এর প্রভাব পড়ছে। এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এবং এটা আমাদের কল্পনা শক্তিকেও প্রভাবিত করে। তাহলে কি স্ক্রিন পুরোপুরি এড়িয়ে চলা উচিত? না, সেটা বর্তমান যুগে সম্ভব নয়। স্ক্রিন আমাদের জীবনের একটা অংশ, কিন্তু আমাদের পুরো জীবন নয়। ব্যালান্স করা দরকার। প্রথমত, আমাদের সচেতন হতে হবে। দিনে কতটা সময় স্ক্রিনে কাটাচ্ছি, সেটার হিসাব করা দরকার। দ্বিতীয়ত, স্ক্রিন-ফ্রি সময় বের করতে হবে। যেমনÑ খাবার সময়, ঘুমানোর আগে অন্তত এক ঘণ্টা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সময়Ñ এসব সময় ফোন দূরে রাখা উচিত। তৃতীয়ত, চোখের বিশ্রাম প্রয়োজন। প্রতি ২০ মিনিটে ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরের কোনো কিছু দেখতে হবে।
চতুর্থত, বিকল্প কাজ খুঁজতে হবে। কাগজের বই পড়া, ছবি আঁকা, লিখা, বাগান করা, রান্না করাÑ এসব কাজ কল্পনা শক্তি বাড়ায়। পঞ্চমত, প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটানো প্রয়োজন। সবুজ গাছপালা, খোলা আকাশ, নদী, পাহাড়Ñ এগুলো মস্তিষ্ককে রিফ্রেশ করে এবং কল্পনা শক্তি বাড়ায়। আমরা আমাদের সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার আগে সচেতন হওয়া প্রয়োজন, কারণ কল্পনা শক্তি মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি, যেটা আমাদের অন্যসব প্রাণী থেকে আলাদা করেছে।
তামান্না ইসলাম, শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

