বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে শহরের অলিগলিতে প্রতিনিয়ত শোনা যায় ‘ইউরোপ যাইতে পারলে জীবন বদলাইয়া যাইব’। পরিবার-পরিজনের আশা, দারিদ্র্য থেকে মুক্তির স্বপ্ন, আর্থিক নিরাপত্তা ও সমাজে সম্মান সব মিলিয়ে হাজারো তরুণ চোখে ইউরোপই যেন এক স্বপ্নরাজ্য। অথচ এই স্বপ্নই অনেক সময় পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে, কখনো হয়ে ওঠে মৃত্যুর ফাঁদ, আর মাঝেমধ্যে ভেসে ওঠে অচেনা সাগরের বুকে শবযাত্রার নৌকা।
ইউরোপমুখী স্বপ্নের পেছনের গল্প
বাংলাদেশে বেকারত্ব, অপ্রতুল কর্মসংস্থান ও বৈষম্যের বাস্তবতায় অনেকেই মনে করেন ইউরোপে গেলেই অর্থ, সম্মান ও নিরাপদ জীবন হাতের মুঠোয় ধরা দেবে। এই মানসিকতা কাজে লাগায় মানবপাচারকারী চক্র। তারা প্রলোভন দেখায়, কয়েক লাখ টাকা দিলেই ইতালি, গ্রিস বা স্পেনে পৌঁছে যাবে। ভিসা লাগবে না, শুধু লিবিয়া হয়ে নৌকায় উঠলেই ইউরোপ। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষগুলো এসব প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে। আমার পরিচিত দুই তরুণের গল্প বলি। রাকিব এবং সজীব। চাচাতো ভাই। ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়। অথচ পড়াশোনায় ছিল অপার সম্ভাবনা। ছাত্র হিসেবে প্রথম সারির না হলেও খারাপ ছাত্র বলা যাবে না তাদের। পারিবারিক অবস্থানও সম্মানজনক। তারা জেদ ধরল ইতালি যাবে। সন্তানের জেদ ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাদের পরিবার জমানো টাকা ও জমি বিক্রি করে প্রায় ১৫ লাখ টাকা দালালদের হাতে তুলে দেয়। ২০ দিন পরে তারা যাত্রা করে লিবিয়ার উদ্দেশ্যে, সেখান থেকে ইউরোপের দেশ ইতালিতে। চোখের জলে মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজন সেদিন বিদায় দেয় তাদের। কিন্তু তাদের সেই চোখের জল এখনো ঝরছে।
কারণ প্রায় বছর খানেক ধরে তাদের কোনো খোঁজ পাচ্ছে না পরিবার। তারা বেঁচে আছে কিনা তাও যানে না। টেলিভিশন, পত্রিকা আর সোশ্যাল মিডিয়ার সতর্ক দৃষ্টি তাদের। লিবিয়া থেকে ইতালি যাবার কোনো নৌকা দুর্ঘটনার খবর এলেই তারা খোঁজে রাকিব এবং সজীবের নাম আছে কিনা?
এত গেল আশায় বুক বেঁধে থাকার গল্প। নিরাশা আর হতাশার গল্প। যারা নিয়মিত পত্রিকার পাতায়, টিভির পর্দায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখেন তারা জানেন, কত স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় প্রতিদিন। যেসব মায়েব বুক খালি হয়, যেসব পরিবারের স্বপ্ন ভঙ্গ হয় কেবল তারাই জানেন এই ক্ষত কোনোদিন মোছার নয়।
মৃত্যুর সাগরপথ
লিবিয়ার উপকূল থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় নৌকাডুবির ঘটনাই সবচেয়ে ভয়াবহ। অতিরিক্ত যাত্রী, অপর্যাপ্ত জ্বালানি, ত্রুটিযুক্ত নৌকা আর দিকনির্দেশনা না জানায় মাঝপথে আটকে পড়ে শত শত অভিবাসনপ্রত্যাশী। অনেকে সাগরে ডুবে মারা যায়, অচেনা তরঙ্গে গিলে নেয় শত শত প্রাণ।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভূমধ্যসাগরে অন্তত ৩,০৪১ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী প্রাণ হারান, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছিলেন বাংলাদেশি। এ বছর (২০২৪) প্রথমার্ধেই ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশিকে লিবিয়ায় আটকে রাখা হয়েছে।
প্রতারণা ও বন্দিদশা
কেবল সাগরই নয়, ইউরোপে পৌঁছানোর আগেই অনেকের জীবন আটকে যায় মরুভূমি কিংবা লিবিয়ার গোপন ক্যাম্পে। পাচারকারীরা জিম্মি করে রাখে, মারধর করে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে। পরিবার টাকা না পাঠাতে পারলে শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। অনেকে সেখানে দীর্ঘদিন বন্দিদশায় থেকে মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েন।
শোকের কান্না দেশে
একেকটি লাশ যখন কফিনে ভরে দেশে আসে, তখন ভেঙে পড়ে অসংখ্য পরিবার। যে সন্তানের জন্য মা গরুর দুধ বিক্রির টাকা জোগাড় করেছিলেন, যে ভাইয়ের জন্য জমি বন্ধক দেওয়া হয়েছিল, সে ফিরছে লাশ হয়ে। সম্প্রতি ইতালি ও গ্রিসের সমুদ্রপথে ডুবে
যাওয়া নৌকায় প্রাণ হারানো তরুণদের অনেকেই ছিলেন সিলেট, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, নোয়াখালী ও কুমিল্লার বাসিন্দা।
সমাধানের পথ
অবৈধ পথে বিদেশযাত্রা রোধে কেবল সীমান্তে কড়া নজরদারি নয়, প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি। তরুণদের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন, বৈধ অভিবাসনের সহজ ব্যবস্থা এবং প্রতারক চক্র দমনে কঠোর আইন প্রয়োগ জরুরি। পরিবারকেও সচেতন হতে হবে দালালের প্রলোভনে পা না দিয়ে বৈধ ও নিরাপদ অভিবাসন বেছে নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। পাশাপাশি তরুণদের চোখেমুখে যে ভ্রান্ত স্বপ্ন থাকে ইউরোপ নিয়ে তার দূর করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বপ্ন পূরণ নয় বরং জীবন বাঁচিয়ে স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটলে তাতে নিজের ভবিষ্যৎ ও পরিবারের স্বপ্ন দুটোতেই সফল হওয়া যায়।
স্বপ্নের ইউরোপ আমাদের দেশের লাখো লাখো তরুণের কাছে প্রেরণার নাম। কিন্তু যখন সেই স্বপ্নের নৌকা ভেসে ওঠে লাশবাহী শবযাত্রা হয়ে, তখন প্রশ্ন জাগে, স্বপ্নের এই মূল্য কি এতটাই ভয়াবহ হতে হবে? এখনই সময় সরকার, সমাজ ও পরিবার সবাইকে মিলে অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে এগিয়ে আসার। তা না হলে ভূমধ্যসাগরের বুকে আরও অনেক শবযাত্রার নৌকা ভেসে চলবে, আর স্বপ্নভঙ্গের কান্না ভরি করে তুলবে সুজলা-সুফলা এই বাংলাদেশ।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন