দূরত্বের ভালোবাসা নিয়ে কোক স্টুডিও বাংলার নতুন গান ‘লং ডিসট্যান্স লাভ’। প্রকাশিত হওয়ার পরপরই সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে গানের গায়ক অংকন কুমার। এর আগেও তার লেখা সুর এবং গায়কীতে ‘উপ’নামক একটি গান পৌঁছেছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এই উদীয়মান তারকার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরফান হোসাইন রাফি
অনেক দিন পর গান করলেন, অনুভূতি কেমন এবং কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
অনুভূতি বেশ ভালোই। অনেক দিন পর একটা মৌলিক বাংলা গান বানানো হলো, এটা সত্যিই আনন্দের! সবাই বলছে গানটি বেশ ভালো হয়েছে। বয়সের ব্যবধান ঘুচিয়ে অনেক বয়স্ক মানুষ যেমন বলছেন যে গানটি ভালো লেগেছে, তেমনি অনেক তরুণ-তরুণীর কাছ থেকেও প্রশংসা পাচ্ছি। আমি আসলেই ব্যপারটায় খুব খুশি।
কোক স্টুডিওর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
আমি সম্ভবত পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিলাম, তখনই অর্ণব দার ফোন আসে। তিনি বললেন, দূরত্ব নিয়ে একটি ট্র্যাকের ওপর কাজ করতে হতে পারে। পরে তার সঙ্গে কথা হয়, দেখা হয় এবং আর যারা কাজ করবেন তাদের সঙ্গেও আলাপ হয়। এরপর তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, এবার আমরা ট্র্যাকের কাজ শুরু করতে পারি। গানটির গল্পটা আসলে দূরত্বকে কেন্দ্র করে। প্রগতা বাইরে থাকে, আমি এখানে এই দূরত্বের মাঝেই তৈরি হয়েছে গানটি। অসাধারণ একটি ব্যাপার! প্রগতা সত্যিই দুর্দান্ত একজন শিল্পী! শুধু গায়কী নয়, রাইটার এবং কম্পোজার হিসেবেও সে ভীষণ প্রতিভাবান। আমার মনে হয়েছে, অর্ণব দা আর শুভেন্দু দা পুরো বিষয়টিকে যেভাবে সাজিয়েছেন, সেটি ছিল সত্যিই অসাধারণ। সব মিলিয়ে দারুণ একটি অভিজ্ঞতা বলা যায়।
গানের নাম ‘লং ডিসট্যান্স লাভ’ কেন?
আমাদের টপিকটাই ছিল দূরত্বকে কেন্দ্র করে। দূরত্বের গল্প নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দুইজন লেখক দুই ভিন্ন জায়গা থেকে এই গানটি লিখেছেন। যেহেতু এটি মূলত একটি লাভ স্টোরি, তাই নামের মধ্যে সেই দূরত্ব ও ভালোবাসার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। পাশাপাশি এটি কোক স্টুডিওর একটি অরিজিনাল ট্র্যাক হওয়ায় আমরা চেয়েছি নামটি যেন আন্তর্জাতিকভাবে মর্যাদা বহন করে এবং বিশ্বদর্শকের কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই নামটি রাখা হয়েছে ‘লং ডিসট্যান্স লাভ’।
গানের লিরিক্সের অন্তরালটা জানতে চাই
এখানে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আছে, গানটির শুরুতে কোনো লিরিক্সই ছিল না। এটা শুভেন্দু ভাইয়ের কম্পোজিশন, তো আমি আর উনি যখন প্র্যাকটিস করছিলাম, তখন প্রথমে গুনগুন করে তাল বের হয়। তারপর আস্তে আস্তে লিরিক্সের জায়গাগুলো তৈরি হতে থাকে। অর্ণব দা আর শুভেন্দু ভাই আমার পছন্দের যেসব ইন্সট্রুমেন্ট আছে, সেগুলোকে অনেক সুন্দরভাবে গুরুত্ব দিয়ে সেটআপ করেছেন। এর ফলে আমার লিরিক্স লেখার সময় অনেক সাহায্য হয়েছে; কোথায় কোন লাইনটা লিখলে ভালো লাগবে
সেটা বুঝতে পেরেছি। শুভেন্দু ভাই পুরো বিষয়টা খুব যতœ নিয়ে মনিটরিং করেছেন। আর প্রগতার লিরিক্সও ছিল দারুণ। আসল ফিলিংসগুলো সে তুলে ধরতে পেরেছে, কিন্তু আমি পেরেছি কিনা সেটা আসলে শ্রোতারাই সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন।
আপনার সঙ্গে আফরিনের গাওয়ার পরিকল্পনা কীভাবে এলো?
সত্যি বলতে এখানে আফরিনের গান গাওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। প্রগতার আসার কথা ছিল, কিন্তু কোনো একটা ঝামেলার কারণে সে আসতে পারেনি। তখন আমরা এই কম্পোজিশনের সঙ্গে মানানসই একটি ভয়েস খুঁজছিলাম। এরপরই আফরিন যুক্ত হলো। সে যুক্ত হয়ে দারুণ করেছে, তার পার্টটুকুও অনেক বেশি সুন্দর ছিল।
এই গানের সুরে কিছুটা ‘উপ’-এর ছোঁয়া পাওয়া যাচ্ছে, এটা কি ইচ্ছাকৃতভাবেই?
আমার একটা পছন্দের কর্ড আছে ‘সেভেন কর্ডস’ (ডি সেভেন)। কিছু বিশেষ গান বাদে আমার যতগুলো গান আছে, প্রায় সবগুলোতেই এই কর্ড বা আমার পছন্দের কিছু কর্ড থাকে। শুভেন্দু ভাইও সেভাবেই কম্পোজ করেছেন। তাই এই গানে এই কর্ডটা ছিল বলেই শ্রোতারা সুরে ‘উপ’-এর ছোঁয়া পাচ্ছেন।
গানে আপনাকে কম দেখা যায় কেন?
আমি আসলে গানের ক্ষেত্রে সাউন্ডকে খুব গুরুত্ব দিই। আমি চাই আমার গানের সাউন্ডগুলো যেন সুন্দর হয় এবং সবাই পছন্দ করে। কারণ একেক ধরনের জনরায় আসলে একেকভাবে সাউন্ড করা হয়। এটা একটা আর্ট, এখানে কারিগরিরও একটা ব্যাপার আছে। তাই সময় নিয়ে এসব কাজ করতে আমার ভালো লাগে।
আপনার প্রথম প্রকাশ পাওয়া গান কোনটি?
‘উপ’ গানটিকেই আমার প্রথম সোলো গান বলতে পারেন। তবে এর আগেও আমার বেশকিছু গান ছিল, যেগুলো এখন আর ইউটিউবে নেই।
‘উপ’ গানটি কবে লিখেছিলেন?
এই গানটি করোনার সময় লেখা, যখন সবাই ঘর থেকে বের হতে পারছিল না। তখন আমার ১০২ ডিগ্রি জ্বর ছিল! সে সময় আমি আর আমার গিটার ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রই ছিল আমার বন্ধু। তখনই এই গানটি লিখি। অনেক কিছু, অনেক ভাবনা মাথায় ঘুরছিল, কিন্তু কোথাও যেতে পারছিল না, কারণ আমি বাসাতেই বন্দি ছিলাম। এজন্যই গানটি ওইভাবে কম্পোজ করা হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, তখনো ঝড় হচ্ছিল, আর এখনো কিন্তু ঝড় হচ্ছে! এটা আসলেই এক অদ্ভুত মিল। আমি জানি না কীভাবে এটা অপ্রত্যাশিতভাবে হয়ে যায়।
আপনার পছন্দের শিল্পী কারা?
সত্যি বলতে এত নাম আলাদা করে বলা সম্ভব নয়। আমি তো কম্পোজার, তাই সবার গানই শুনতে হয়, সবার গানই আমার ভালো লাগে। কারণ সবার কাছেই সুর আছে, আর সবার কাছ থেকেই আমি অনেক কিছু শিখি।
ব্যতিক্রমী লিরিক্সের ধারা কীভাবে তৈরি করলেন?
আমার প্রতিটি লিরিক্সই প্রবাহিত হয়, তাই অনেকটা কবিতার মতো বলা যায়। আমার ব্যক্তিগত জীবনে যত চাওয়া-পাওয়া এবং অভিজ্ঞতা আছে, সেই অনুভূতি বা আবেগগুলোই আমি গানে রূপান্তর করার চেষ্টা করি।
‘যদি বিরহ থাকে আমিও থাকি’ লাইনে বিরহের সঙ্গে আপনার থাকা না থাকার সম্পর্ক কোথায়?
আমি আসলে সবদিক থেকেই সরাসরি। এই গানের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এ রকমই। কষ্টটাও যদি থাকে এবং আমিও যদি থাকি, তাহলে এ গল্পটার শেষে কী হতে পারে? সেটা আমার শ্রোতাদের কাছে প্রশ্ন। কষ্ট-যাতনা যদি মানুষ নিয়ে থাকে, তাহলে গল্পের শেষে মানুষটা শেষ হয়, নাকি দুঃখটা শেষ হয়?
গানের জগতে আপনার পদার্পণ কীভাবে?
আমি পারিবারিক সূত্রেই গানের সঙ্গে জড়িত, পরিবারের অনেকেই শিল্পের সঙ্গেই ছিলেন। ছোটবেলা থেকে ক্লাসিক্যাল মিউজিক করতাম। তখন আমার সুর নিয়ে কিছুটা ঝামেলা হতো। পরে বড় হয়ে আমি খুঁজতে থাকি অন্য সাউন্ডে কীভাবে ওই নোটেশনগুলো বসে, আর সাউন্ডে কীভাবে নতুনত্ব তৈরি করা যায়। সেখান থেকেই আজকের যাত্রা, যা আমার গভীর চর্চার ফল বলা যায়।
সামনে নতুন কোনো গান আসবে?
হ্যাঁ, আমি সামনে আমার অ্যালবাম রেকর্ড করছি। রেকর্ডিং এবং সাউন্ডের কাজ ফাইনাল হয়ে এলেই শ্রোতারা একে একে গানগুলো শুনতে পারবেন। পাশাপাশি ভিন্নধর্মী সাউন্ডে কিছু প্রজেক্টের কাজও চলমান। আমাদের দেশের ফ্যান্টাস্টিক মিউজিশিয়ান ও কম্পোজারদের করা এসব কাজ ইনশাআল্লাহ আমরা পাব। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সেটা আগামী বছরেই হতে পারে।
গানের জগতে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
জানি না, আসলে ওভাবে চিন্তা করিনি কখনো। তবে আমি অনেক ভালো গান বানাতে চাই, এটাই আমি জানি। অনেক সুন্দর গান এবং নতুন নতুন সাউন্ড তৈরি করতে চাই, যেসব সাউন্ড বাংলাদেশে আগে কেউ চেষ্টা করেনি, কিন্তু বাংলা গানের ঐতিহ্যের বিষয়টি ধরে রাখবে। এ রকম কিছু কাজ করার ইচ্ছে আছে। বাকিটা দেখা যাক কী হয়।