নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের অবাধ বিক্রিতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে কুমিল্লার সাধারণ মানুষ। শহর থেকে গ্রাম প্রতিটি জায়গায় অসংখ্য ফার্মেসিতে বিক্রি হচ্ছে এসব ওষুধ। আবার যেসব ফার্মেসিতে এসব ওষুধ বিক্রি হচ্ছে তার অধিকাংশেরই নেই সরকারি অনুমোদন বা বৈধ লাইসেন্স।
স্বাস্থ্য বিভাগ ও ওষুধ প্রশাসনের তথ্যমতে, কুমিল্লায় বর্তমানে প্রায় ৬৫০টি ফার্মেসি কোনো বৈধ লাইসেন্স ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। এর বড় একটি অংশ চালাচ্ছেন প্রশিক্ষণহীন ব্যক্তি, যাদের নেই ফার্মাসিস্টের সনদ বা ওষুধ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় জ্ঞান। ফলে সহজেই এসব দোকানে প্রবেশ করছে নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ মানুষ ও ওষুদের দোকানে যারা থাকেন তারা ভেজাল ওষুধ চিনতে পারবে না। এ জন্য ফার্মেসিতে প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট থাকা জরুরি। এ ছাড়া প্রশাসনের নিয়মিত তদারকি না থাকলে নকল ওষুধের বিস্তার ঠেকানো কঠিন।
সরেজমিনে কুমিল্লা শহরের কয়েকটি ওষুধের দোকানে দেখা গেছে, ব্যথানাশক, অ্যান্টিবায়োটিক, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের মতো গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে পুরোনো মোড়কে বা পরিবর্তিত ম্যানুয়ালে। কিছু দোকানে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ওষুধ রাখা হয়েছে বিক্রির জন্য।
কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাসিন্দা মোক্তার হোসেন জানান, তার মা ও সন্তান নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন। গত তিন মাসে ওষুধের পেছনে প্রতি মাসে আগের তুলনায় বাড়তি দেড় থেকে দুই হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। আগে যে ওষুধ ৩৬০ টাকায় পাওয়া যেত, এখন সেটি ৪২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তার মতে, এটি মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার যেসব ওষুধ কেনা হচ্ছে তা আসল না নকল তা বুঝার উপায় নেই।
ঝাউতলা এলাকার মরিয়ম ফার্মেসির বিক্রেতা মো. সাজ্জাদ হোসেন জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় সব কোম্পানি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। অনেক ওষুধে নতুন মূল্য লেখা না থাকায় পুরোনো মোড়কেই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ভোক্তাদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে।
ফার্মেসি মালিকদের অভিযোগ, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছে। কিন্তু কোনো কোনো কোম্পানি নতুন দামের মোড়ক পাঠাচ্ছে না, ফলে দোকানিরা দাম নির্ধারণে দ্বিধায় পড়ছেন। যেমন- এ-ফ্লক্স ১০ ট্যাবলেটের দাম ১০৫ টাকা থেকে বেড়ে ১৪০ টাকা, বাইজোরান ১০০ থেকে ১২০ টাকা, লিনাগ্লিপ-এম (ডায়াবেটিসের ওষুধ) ৩৬০ থেকে বেড়ে ৪২০ টাকা হয়েছে।
মুরাদনগর উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামের বাসিন্দা হোসনে আরা বেগম জানান, তার স্বামী ও নিজে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ওষুধ খান। গত মাসে একই ধরনের ওষুধ কিনেও তেমন উপকার পাননি। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ বদলাতে হয়েছে। নতুন ওষুধে কিছুটা উপকার পেলেও আগেরটার কার্যকারিতা ছিল না বলে অভিযোগ তার।
এমন অবস্থার মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বড় ধরনের তদারকি বা অভিযান খুব একটা চোখে পড়ছে না। কুমিল্লা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সালমা সিদ্দিকা জানান, নিয়মিত বাজার তদারকি ও অভিযান পরিচালনা করা হলেও নতুন ওষুধ ও প্রসাধনী আইন এখনো তফসিলভুক্ত না হওয়ায় অভিযান চালাতে কিছু আইনি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আইনটি চূড়ান্তভাবে কার্যকর হলে আরও কঠোরভাবে মাঠে নামা যাবে বলে তিনি মনে করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সংকট শুধু অভিযানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ওষুধের দাম নির্ধারণ ও পর্যবেক্ষণে একটি স্বচ্ছ ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেখানে প্রতিটি কোম্পানির আপডেটেড দাম উল্লেখ থাকবে। ফার্মেসিতে লাইসেন্স ঝুলিয়ে রাখার বাধ্যবাধকতা কার্যকর করার পাশাপাশি সরকারিভাবে মোবাইলভিত্তিক ওষুধ যাচাই অ্যাপ চালু করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
বিএমএ কুমিল্লার সভাপতি ডা. আতাউর রহমান জসিম বলেন, ‘ভেজাল ওষুধ সাধারণ মানুষ চিনতে পারবে না। তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ কিনতে হবে। এবং এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের তদারকি অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া প্রতিটি ফার্মেসিতে একজন ফার্মাসিস্ট থাকতে হবে। তাহলে ভেজাল ওষুধের ছড়াছড়ি কমবে। প্রশাসনের উচিত লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসিগুলোয় ওষুধ বিক্রির অনুমতি না দেওয়া।’
কুমিল্লা ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কাউছার মিয়া বলেন, ‘ওষুধের দাম বেশি কিংবা নকল ওষুধ বিক্রির অভিযোগে আমরা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কুমিল্লা সিভিল সার্জন ডা. আলী নুর মোহাম্মদ বশীর আহমেদ বলেন, ‘আমরা ভেজাল বা নকল ওষুধের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। ফার্মেসি বা অন্য কোথায় এ ধরনের ওষুধ পাওয়া গেলে বা এমন কোনো অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবও।’