যশোরের ‘দুঃখ’ হিসেবে পরিচিত ভবদহে আবারও ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। টানা বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। ২১ ভেন্টের স্লুইসগেটের মাত্র ছয়টি কপাট খোলা থাকায় যথাযথ পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পানি নিষ্কাশনে একের পর এক প্রকল্পে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হলেও মিলছে না স্থায়ী সমাধান। বছরের পর বছর জলাবদ্ধতার সঙ্গে লড়াই করে তারা এখন ক্লান্ত ও হতাশ। তারা অবিলম্বে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন।
জানা গেছে, জলাবদ্ধতা ভবদহের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষা এলেই ভবদহ পাড়ের মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। বৃষ্টির পানিতে অর্ধশতাধিক গ্রামে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এবারও গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে ভবদহের ৫২টি বিল প্লাবিত হয়েছে। পানি উপচে আশপাশের গ্রামে ঢুকছে। এরই মধ্যে ৪৫টি গ্রামে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। পরিমাণ আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সূত্র জানায়, ১৯৬০ সালের দিকে যশোর সদর, মনিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর উপজেলা এবং খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার মধ্যবর্তী ভবদহ নামক এ স্থানে পানি নিষ্কাশনের জন্য শ্রীনদীর ওপর নির্মাণ করা হয় ২১ ভেন্টের স্লুইসগেট। পরবর্তী সময় প্রায় ২০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৮ লাখ মানুষের মারণফাঁদে পরিণত হয় এ গেট। স্লুইসগেটের ২১টির কপাট দিয়ে শ্রীনদী, টেকা ও মুক্তেশ্বরী নদীসহ বিল কেদারিয়া, বিল বকর ও বিল আড়পাড়াসহ যশোর ও খুলনা এলাকার মোট ২৭টি বিলের পানি নিষ্কাশন হওয়ার কথা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।স্লুইসগেটের অধিকাংশ কপাট বন্ধ থাকে।
এ ছাড়া দফায় দফায় টিআরএম প্রকল্প চালু করে ছোট ছোট প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো স্থায়ী উন্নতি হয়নি।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ভবদহ অঞ্চলে পানি ওঠানামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদীর মাধ্যমে। তবে পলি পড়ে নদীগুলো নাব্য হারানোয় পানি নিষ্কাশনে সমস্যা হচ্ছে। ফলে পানি নিষ্কাশনের জন্য স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। অন্যথায় ভবদহ পাড়ের মানুষের কষ্টের শেষ নেই।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির তথ্যমতে, ভবদহ অঞ্চলে এরই মধ্যে মনিরামপুরের কুলটিয়া ইউনিয়নে ১৪টি গ্রাম, চলিশা ইউনিয়নে ৫টি, সুন্দলী ইউনিয়নে ১০টি, পায়রা ইউনিয়নে ৫টি হোগলাডাঙ্গা ইউনিয়নে ৮টি নেহালপুর ইউনিয়নে ৩টি গ্রামসহ মোট ৪৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্রতিদিন সংখ্যা বাড়ছে। বাড়িঘর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফসলের জমি উপাসনালয় পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, টানা বৃষ্টিতে অভয়নগর উপজেলার কোটা, চলিশিয়া, বাগদাহ, আন্ধা, বলারাবাদ, বেতভীটা, সরখোলা, ডুমুরতলা, সুন্দলী, ডহর মশিয়াহটী, বাড়েধা, দীঘলিয়া, ভাটাডাঙ্গী, বারান্দিসহ আরও কয়েক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি জীবনযাপন করছেন। ভেসে গেছে শত শত মাছের ঘের। তলিয়ে গেছে শত শত হেক্টর আবাদি জমি। বসতবাড়ির উঠানে কোমর পানি জমেছে। মানুষ ও গবাদিপশু একসঙ্গে বসবাস করছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাঁটুপানি রয়েছে।
ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের দিলীপ বিশ্বাসের বাড়ির উঠানে হাঁটুপানি। উঠানের পানিতে তিনি মাছ ধরার চাঁই পাতছিলেন। তিনি বলেন, বৃষ্টির সঙ্গে ওপরের দিকের জল চাপ দেওয়ায় পানি বেড়েই চলেছে। উঠানে বাঁশের সাঁকো তৈরি করেছি। ঘর থেকে সাঁকো দিয়ে বের হচ্ছি। পানি আরেকটু বাড়লে ঘরে ঢুকবে। একই গ্রামের সুভাষ বিশ্বাস বলেন, খুবই খারাপ অবস্থায় আছি। যেভাবে পানি বাড়ছে তাতে এবারও জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নেবে।
চঞ্চল কুমার বিশ্বাস জানান, এভাবে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। যেভাবে হোক তারা জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান চাইছেন।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রনজিত বাওয়ালি জানান, সরকারের পক্ষ থেকে আমডাঙ্গা খাল ৮১ কিলোমিটার নদী খনন এবং টিআরএম করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করলেও তার দীর্ঘসূত্রতা জন্য আবারও বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে। সম্প্রতি ভবদহ স্লুইসগেটের ২১ ভেন্টের চারটি থেকে এখন ছয়টি কপাট খোলা। বাকি কপাটগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। কপাটগুলো খুলে দিলে দ্রুত পানি বের হয়ে যাবে। এ ছাড়া জরুরি ভিত্তিতে আমডাঙ্গা খাল সংস্কারের কাজ, নদী খনন ও টিআরএম বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জি জানান, জলাবদ্ধতা নিরসনে ভবদহের স্লুইসগেটের ৬টি কপাট চালু রয়েছে। স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা নিরসনে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে চীনা বিশেষজ্ঞ দল ভবদহ অঞ্চল পরিদর্শন করেছে।
যশোর জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম জানান, ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বর্তমান সরকার আন্তরিক। পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
আপনার মতামত লিখুন :