রাজশাহী-আব্দুলপুর রেললাইন:
- স্বাভাবিক আয়ুষ্কালের দ্বিগুণের বেশি লাইনের বয়স
- ১৯৬২ সালের পর বড় ধরনের সংস্কার হয়নি
- ৪৫ কিলোমিটার লাইনের ৩৫ কিলোমিটার জরাজীর্ণ
- লাইন সংস্কারে প্রকল্প পাঠানো হয়েছে: মহাব্যবস্থাপক
গ্রামবাসীর প্রচেষ্টায় আবারও বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেল পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অন্তত সাতটি ট্রেন। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজশাহী থেকে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে ‘বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি ছেড়ে যায়। এর পরই রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বালুদিয়াড় এলাকায় রেললাইনের অন্তত দুই ফুট অংশ ভেঙে যায়। স্থানীয় এক তরুণ ভাঙা অংশটি দেখতে পেয়ে গ্রামবাসীকে খবর দেয়। গ্রামবাসী লাইট ও লাল কাপড় নিয়ে রেললাইনে দাঁড়িয়ে খুলনা থেকে রাজশাহীগামী সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে থামিয়ে দেয়। নয়তো প্রায় ৭০০ যাত্রী নিয়ে চলা ট্রেনটি দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতো। এ ঘটনার পর তিন ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় ছয়টি ট্রেন আটকা পড়ে।
কিন্তু রেললাইনের পাত ভেঙে যাওয়া কিংবা ট্রেন দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া এ রুটে এবারই প্রথম নয়। ৬৩ বছরের পুরোনো সিঙ্গেল ব্রডগেজ রেললাইন দিয়ে প্রতিদিন ১৫টি ট্রেন ৩০ বার যাতায়াত করছে। চলাচল করছে মালবাহী ট্রেনও। অত্যাধিক চাপ আর লাইন পুরোনো হওয়ায় তৈরি হচ্ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। ফলে কখনো ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে, কখনো আবার রেললাইনের পাত ভেঙে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে রেল যোগাযোগ। তাতে প্রতিবছর এ রুটে নতুন ট্রেন কিংবা ইঞ্জিন যুক্ত হলেও নিস্ফল করে দিচ্ছে জরাজীর্ণ রেললালইন। ফলে যমুনা নদীতে রেলসেতু হলেও সুফল পাচ্ছে না রাজশাহীবাসী।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী থেকে আব্দুলপুর জংশন পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার সিঙ্গেল রেললাইন রয়েছে। এ রেললাইনের রাজশাহী থেকে চারঘাটের সরদহ রোড স্টেশন ও নন্দনগাছী স্টেশন হয়ে বাঘার আড়ানী স্টেশন পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কিলোমিটার রেললাইন সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। একমাত্র রেলব্রিজটিও (বড়াল রেলসেতু, আড়ানী) ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ফলে পুরোনো রেললাইন, দুর্বল সিøপার ও ঝুঁকিপূর্ণ রেলসেতুর কারণে মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে ট্রেন। অথচ রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সঙ্গে সারা দেশে রেল যোগাযোগের এটিই একমাত্র রুট।
জানা যায়, স্বাভাবিকভাবে একটি রেললাইনের আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২৫ থেকে ৩০ বছর। অথচ এ লাইনের (ট্র্যাক) বয়স স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল দ্বিগুণের বেশি। রাজশাহী থেকে আব্দুলপুর পর্যন্ত রেললাইনটি সর্বশেষ বড় ধরনের সংস্কার করা হয় ১৯৬২ সালে। এরপরে আর কোনো সংস্কার কাজ হয়নি। ৪৫ কিলোমিটার এ রেললাইন সিঙ্গেল ব্রডগেজ থেকে ডাবল লাইনে উত্তীর্ণ করতে কাজ শুরু করা হয় ২০০০ সালের দিকে। কিন্তু দুই যুগেও সেই প্রকল্পের কাঙ্খিত অগ্রগতি নেই। দুই যুগ পরেও এখনো প্রকল্পটি সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর্যায়ে রয়েছে। ফলে জরাজীর্ণ রেললাইনে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম গতিতে ট্রেন চলছে।
এর আগে গত বছরের ২৯ জানুয়ারি চারঘাটের বাগমারী এলাকায় রেললাইনের ১০ ইঞ্চি লাইন ভেঙে যায়। এক কৃষক জমিতে কাজ করতে যাওয়ার সময় বিষয়টি দেখতে পেয়ে স্থানীয়দের ডেকে এনে কাছে থাকা লাল গামছা উড়িয়ে রাজশাহীগামী ‘বরেন্দ্র এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি থামিয়ে দেয়। সেবার ওই ট্রেনের প্রায় ৫০০ যাত্রী প্রাণে রক্ষা পায়।
গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি একই কায়দায় ঢাকাগামী ‘বনলতা এক্সপ্রেস’ টেন গামছা দিয়ে থামিয়ে ৮৫০ যাত্রীর প্রাণ রক্ষা করেছিল দুই কৃষক। সেবারও লাইনের ৮ ইঞ্চি জায়গা ভেঙে গিয়েছিল।
এর আগে ২০২৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আড়ানী রেলসেতুর লাইনের ১৫ ইঞ্চি ভেঙে যায়। সেখানকার গেটম্যান বিষয়টি দেখতে পেয়ে লাল কাপড় উঁচিয়ে রাজশাহীগামী ‘উত্তরা এক্সপ্রেস’ ট্রেন থামিয়ে হাজারো যাত্রীর জীবন রক্ষা করেন। পরে তাকে পুরস্কৃত করে রেলের পাকশী বিভাগ। এ ছাড়াও এ রুটে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটছে। কখনো যাত্রীবাহী ট্রেন আবার কখনো ভারী মালবাহী ট্রেন।
সরেজমিন রাজশাহী-আব্দুলপুর রুটের চারঘাট ও বাঘা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রেললাইন ও সিøপারগুলোর বেহাল অবস্থা। সিøপারকে যথা স্থানে রাখতে যে পরিমাণ পাথর প্রয়োজন, অধিকাংশ স্থানেই তা নেই। যত্রতত্র রেললাইনের মাঝখানে দিয়ে গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানকার লাইনের অবস্থা আরও নাজুক।
১৯১০ সালে নির্মিত আড়ানী রেল ব্রিজে সিøপারের দুই পাশে ৮টি করে পিন দেওয়ার কথা থাকলেও কোনোটাতে দুটি, আবার কোনোটাতে তিনটি, আবার কোনোটাতে একটিও নেই। কোনোটাতে নাট-বল্টু, ক্লিপ, হুক কিছুই নেই। দুই লাইনের গোড়ায় ফিসপ্লেটে চারটি নাট-বল্টু থাকার কথা। স্লিপারগুলো বহু বছরের পুরোনো। ব্রিজটিতে মোট সিøপার ব্যবহার করা হয়েছে ২৬২টি, সেই সিøপারে ২ হাজার ৯৮টি ক্লিপ থাকার কথা। কিন্তু সেখানে রয়েছে প্রায় ৯২৮টি। এদিকে ২৬২টি সিøপারের মধ্যে ৭৩টি সিøপারই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ব্রিজটির পিলারের গোড়ায় অনেক বছর আগে পাথর ফেলা হয়। বর্তমানে পাথর বা মাটি কিছুই নেই।
এ বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আহসান জাবির বলেন, ১৯৬২ সালে নির্মিত রেললাইন, অনেক বয়স হয়ে গেছে। আড়ানী ব্রিজটির বয়সও শত বছরের বেশি। এ অবস্থায় রেললাইনের যে অংশগুলো অনিরাপদ মনে হচ্ছে, সেখানে মেরামত করে রেল যোগাযোগ নিরাপদ রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে রাজশাহীর (পশ্চিমাঞ্চল) মহাব্যবস্থাপক বলেন, ‘রাজশাহী-আব্দুলপুর পর্যন্ত রেললাইনের বিষয়টি নিয়ে আমরা অবগত আছি। ডাবল লাইন নির্মাণের প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। এ ছাড়া রেললাইনের সংস্কারের বিষয়ে আরও একটি প্রকল্প পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে কাজ শুরু করা হবে বলে তিনি জানান।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন