ঢাকা বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৫

এক কর্মকর্তার ৩ জন্ম তারিখ

জাল সনদে ভূমি অফিসে ৩৮ বছর চাকরি

ফয়সাল আহমেদ, রাজবাড়ী
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২৫, ০১:৫৯ এএম

রাজবাড়ী সদর উপজেলার মুলঘর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপ-সহকারী কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামানের বিরুদ্ধে বয়স ও সনদ জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, ভুয়া সনদ ও ভিন্ন জন্মতারিখ ব্যবহার করে তিনি ৩৮ বছর ধরে সরকারি চাকরি করছেন। সেইসঙ্গে তিনি বর্তমানে পদোন্নতির তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন।

কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপ-সহকারী কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক শেখ সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ও ফরিদপুর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। বিভাগীয় কমিশনার (ঢাকা বিভাগ) ও রাজবাড়ী জেলা প্রশাসকের কাছেও অভিযোগের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, মো. আলীমুজ্জামান ১৯৮৭ সালে তৎকালীন তহশীল অফিসে পিয়ন পদে যোগ দেন। তখন জমা দেওয়া অষ্টম শ্রেণির সনদে জন্মতারিখ ছিল ২৫ নভেম্বর ১৯৬৮। পরে ১৯৮৯ সালে এসএসসি সনদে তা পরিবর্তন করে দেখানো হয় ১৪ জুন ১৯৭৩। সম্প্রতি স্থানীয় রাজা সূর্যকুমার ইনস্টিটিউশনের (আরএসকে ইনস্টিটিউশন) ভর্তি রেজিস্টারে পাওয়া গেছে তৃতীয় একটি জন্মতারিখ ০১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০।

বিদ্যালয়ের রেজিস্টার অনুযায়ী, ৩১ জানুয়ারি ১৯৮১ সালে আলীমুজ্জামান ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। পিতার নাম মৃত আবুল হোসেন, অভিভাবক হিসেবে উল্লেখ আছে ইলিয়াস মিয়া (চাচা)। এ তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৭ সালে সরকারি চাকরিতে যোগদানের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর, যা সরকারি চাকরির ন্যূনতম বয়সসীমা ১৮ বছর পূরণ করে না।

রাজা সূর্যকুমার ইনস্টিটিউশন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ১৯৮১ সালের রেজিস্টার বইটি আমাদের অফিসিয়াল রেকর্ড। এখানে গত ৩১/০১/১৯৮১ তারিখে ষষ্ঠ শ্রেণিতে আলীমুজ্জামান নামে একজন ছাত্র ভর্তি হন এবং তার জন্মতারিখ ০১/০২/১৯৭০ হিসেবে লেখা আছে। এটি প্রতিষ্ঠানিকভাবে সংরক্ষিত একটি নির্ভরযোগ্য নথি।

তিনি আরও বলেন, রেজিস্টার অনুযায়ী ভর্তি ক্রমিক নম্বর ৪২, পিতার নাম মৃত মো. আবুল হোসেন, অভিভাবক ইলিয়াস মিয়া (চাচা) এবং পূর্বতন বিদ্যালয় লক্ষ্মীকোল প্রাথমিক বিদ্যালয়।

অভিযোগে আরও বলা হয়, আলীমুজ্জামান কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। ২০০৪ সালে বিষয়টি প্রমাণিত হলে তার দুই বছরের ইনক্রিমেন্ট স্থগিত রাখা হয় (মামলা নং: ০৪/২০০৪)। এ ছাড়া ২০১২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি পরিবারসহ সরকারি কাচারিতে বসবাস করেও বাড়ি ভাড়া ভাতা গ্রহণ করেছেন, যা সরকারি নিয়মের পরিপন্থি। এতকিছুর পরও বর্তমানে তিনি ৩০ জনের মধ্যে পদোন্নতির গ্রেডেশন তালিকার শীর্ষে রয়েছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০০২ সালে তার মা আনোয়ারা বেগম একটি হলফনামা দাখিল করে এসএসসি সনদে জন্মতারিখ সংশোধনের দাবি জানান। তবে আইন অনুযায়ী, এ ধরনের হলফনামা সরকারি নথি পরিবর্তনের জন্য বৈধ নয়।

অভিযোগকারী আব্দুর রাজ্জাক শেখ বলেন, একজন কর্মকর্তার নামে তিনটি জন্ম তারিখ থাকা স্পষ্ট প্রতারণা। ভুয়া সনদ ও বয়স জালিয়াতির মাধ্যমে ৩৮ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ প্রশাসনিক ন্যায়ের পরিপন্থি। আমি দ্রুত তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) পায়রা চৌধুরী বলেন, আমি এই অভিযোগ সম্পর্কে অবগত নই। বিষয়টি সাংবাদিকের কাছ থেকেই শুনলাম।

জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার বলেন, অভিযোগটি বর্তমানে তদন্তাধীন। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিষয়টি দেখছেন। পূর্বে ২০০৪ সালের অভিযোগ বিভাগীয়ভাবে নিষ্পত্তি হয়েছিল।

অভিযুক্ত মো. আলীমুজ্জামান বলেন, বিষয়টি ইউএনও স্যারের অধীনে তদন্তাধীন। যদি দোষী প্রমাণিত হই এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত হই, আইন অনুযায়ী শাস্তি মেনে নেব।