*** নির্বিচারে শিকার করা হচ্ছে পোনা মাছ
*** বিপন্ন হচ্ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক মৎস্যসম্পদ
*** মেঘনায় জেগে উঠা নতুন নতুন চরকে ঘিরে নিষিদ্ধ জালের উপদ্রব
*** মৎস্য কর্মকর্তার ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন
লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের মেঘনায় দিন দিন বাড়ছে অনুমোদনহীন ট্রলিং বোটের দৌরাত্ম্য। ইঞ্জিনচালিত এসব নৌযানে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে নির্বিচারে শিকার করা হচ্ছে পোনা মাছ। ফলে বিপন্ন হচ্ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক মৎস্যসম্পদ। এতে ভেস্তে যাচ্ছে মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন ও মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারের সব ধরনের পরিকল্পনা। অতিদ্রুত খরছি জাল দমানো না গেলে ধ্বংসের মুখে পড়বে দেশের বিশাল মৎস্যসম্পদ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত অসাধু চক্রটি মাছ শিকার করেন। উত্তরের বাতাসে শুরু হয় দক্ষিণা বাতাসসহ প্রায় ছয়-সাত মাস মাছ ধরে। স্থানীয় ভাষায় এটিকে খরছি জাল বলা হয়। প্রতিটি জালের টিমের সঙ্গে একটি ছোট নৌকা আনুমানিক মূল্য ২০-৩০ হাজার টাকা ও একটি বড় নৌকা (ট্রলিং) বোট প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রতিটি জালের মূল্য আড়াই থেকে চার লাখ টাকা। এ জাল দৌলতখাঁ, ঢাকা মুন্সীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ থেকে সরবরাহ করেন। বিশেষ করে ইন্ডিয়া থেকেও আসে। প্রতিটি জালের উচ্চতা ১০-১৫ ফুট, দৈর্ঘ্য প্রায় ২ হাজার ফুট।
সরেজমিন দেখা গেছে, ভোলা জেলা ও লক্ষ্মীপুর জেলার সীমান্তে মাতাব্বরচরসহ মেঘনায় জেগে উঠা নতুন নতুন চরকে ঘিরে নিষিদ্ধ জালের উপদ্রব। এসব জালে যেমন, জাটকা, বাটা, পোয়া, রিটা, আইড়, বোয়াল ও কোরালসহ যাবতীয় সামুদ্রিক মাছ আটকায়। নিয়ম ভঙ্গ করে ৪০ মিটার গভীরতার কম পানিতে ট্রলিং বোটে মাছ শিকার করছেন অসাধু চক্রের সদস্যরা। মাছ ধরে মধ্যরাতসহ ভোরবেলায় স্থানীয় কিছুসংখ্যক আড়তদারদের মাধ্যমে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ঢাকায় চালানসহ উপজেলার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন মাছ। আবার কিছু কিছু মাছ শুঁটকি করে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছেন।
আবুল কালাম মাঝি নামে এক জেলে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইলিশ শিকারের জন্য ট্রলারে আমরা ১৬ জন মানুষ সাগরে ১০ দিনের জন্য যাই। কাক্সিক্ষত ইলিশ মাছ না পেয়ে কূলে ফিরি। অবৈধ ট্রলিং বোটের প্রভাবে আমরা খালি হাতে ফিরে আসি। জাটকাসহ সব প্রজাতির কোটি কোটি টাকার পোনা মেরে ফেলেছে।
চরকালকিনি ইউনিয়নের আজাদ মাঝি বলেন, একটি চক্র গত দুই মাস যাবত মেঘনা নদীতে অবৈধভাবে মাছ শিকার করে। উপজেলা প্রশাসকনসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোন মনিটরিং নেই। ফলে দিন দিন প্রতিযোগিতা করছেন অন্যান্য প্রভাবশালীরাও।
ফিরোজ নামের আরেকজন জেলে বলেন, ট্রলিং বোট হওয়ার পর থেকে আমরা সাধারণ জেলেরা না খেয়ে মরে যাচ্ছি। এরা ছোট জাল দিয়ে সব মাছ ধরে ফেলে; আর আমরা মাছ পাই না। এদের দেখাদেখি এখন অনেক ট্রলার মালিকই এই জাল বানাচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে মাছের আকাল দেখা দেবে। আমরা চাই এসব অবৈধ জাল বন্ধ হোক।’
গবেষকরা বলছেন, নিষিদ্ধ জালে মাছ ধরায় সব ধরনের মাছের পোনা, রেণু ও জলজ প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। ফলে মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বড় মাছের বড় নেতিকবাচক প্রভাব পড়ছে।
তারা আরও বলেন, বর্তমানে সমুদ্রে ক্যাটফিশ প্রজাতির মেদ, মোচন, গাগড়া এবং ট্যাংরা মাছের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। এসব মাছ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় বেশি পাওয়া যায়। বরিশাল ও নোয়াখালী জোনে কোরাল এবং জাভা মাছের উৎপাদনও কমেছে। নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে নির্বিচারে মাছ আহরণ করায় সমুদ্রে মাছ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে লোকসানের মুখে পড়বেন এ অঞ্চলের জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা।
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তুর্য সাহা বলেন, আইন অনুযায়ী খরছি জাল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মেঘনার নদীর দুটি স্পটে মাছ ধরার খবর পাওয়া গেছে। আমরা এ পর্যন্ত কোন অভিযান পরিচালনা করি নাই। খুব দ্রুত প্রশাসনের সহায়তায় অভিযান পরিচালনা করে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি আরও বলেন, একটি চক্র জেলা-উপজেলার বিভিন্ন দোকানে গোপনে এজাল বিক্রি করে আসছে। কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাহাত উজ জামান বলেন, মেঘনায় আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অবৈধভাবে কেউ মাছ শিকার করলে তাদের বিরুদ্ধে মৎস্যসম্পদ আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

