- ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারায় প্রায় ৫ লাখ মানুষ
- নদী, খাল ও গাছে ভাসছিল লাশ; অনেকে স্বজন হারিয়ে নিঃস্ব
- বয়স্ক প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে আজও ভাসে সেই বিভীষিকাময় দৃশ্য
আজ ১২ নভেম্বর, বাংলাদেশের উপকূলবাসীর জীবনে এক ভয়াল দিন। ১৯৭০ সালের এই দিনে আঘাত হানে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। প্রলয়ংকরী সেই দুর্যোগে প্রাণ হারায় প্রায় ৫ লাখ মানুষ। নদী-খালে ভাসছিল লাশ, গাছের ডালে ঝুলছিল স্বজনেরা। এমন দৃশ্য আজও ভুলতে পারেনি উপকূলবাসী।
বরগুনার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের বকুলতলা গ্রামের ৯৩ বছরের প্রবীণ শিক্ষক মনোহর ওঝা, স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ‘মনোহর মাস্টার’ নামে। লাঠির সাহায্যে হাঁটেন, তবু স্মৃতিশক্তি অটুট। কথায় কথায় ফিরে যান ৫৫ বছর আগের সেই বিভীষিকাময় রাতে।
কণ্ঠ কাঁপিয়ে তিনি বলেন, ‘আরও অনেক বন্যা দেখেছি, কিন্তু ’৭০ সালের মতো বন্যা আর দেখিনি। নদী-খাল ভরে গিয়েছিল লাশে। ভোরে বলেশ্বর নদের পাড়ে যেতেই দেখি জলে ভাসছে মানুষ, গবাদি পশু, ঘরের ধ্বংসাবশেষ। লাশ যেখানে পেয়েছি, সেখানেই মাটিচাপা দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বলেশ্বর নদসংলগ্ন খালে জোয়ারের পানিতে লাশ ঢুকছিল। কিছু লাশ ভাটায় ভেসে গিয়েছিল, কিছু পাখিতে খেয়ে ফেলেছিল। আজও চোখ বুজলেই সেই দৃশ্য দেখি, গা শিউরে ওঠে।’
সেই দিনের স্মৃতি জাগিয়ে শত বছর বয়সি আবুল হোসেন বলেন, ‘ওই বন্যায় আমার পরিবারের পাঁচজন মারা যায়। সকালবেলা দেখি, গাছের ডালে ডালে সারিবদ্ধ লাশ। আমি নিজে কাঁঠালগাছের মাথায় উঠে বেঁচেছিলাম। কিন্তু ছোট ভাই আদম আলী, তার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা কেউ ফেরেনি।’
৮০ বছর বয়সি সিরাজুল হক মোল্লা বলেন, ‘সন্ধ্যার পরেই হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়া। মুহূর্তেই পানি উঠে সব ভেসে গেল। সকালেই দেখি ধানক্ষেতে, খালে, গাছে লাশই লাশ। এরকম দৃশ্য আর কোনো দিন দেখিনি।’
১৯৭০ সালের ৮ নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়টি ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ১১ নভেম্বর রাতে উপকূলে আঘাত হানে। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া এই ঘূর্ণিঝড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চল তছনছ হয়ে যায়। বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাণহানি ঘটে লক্ষাধিক মানুষের। এটি ‘সিম্পসন স্কেল’-এর ক্যাটাগরি-৩ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল, যা আজও বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত।
ভয়াল ১২ নভেম্বরের স্মরণে আজ দেশব্যাপী পালিত হচ্ছে ‘উপকূল দিবস’। বরগুনার পাথরঘাটায় ‘পাথরঘাটা উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন’-এর আয়োজনে বেলা ১১টায় প্রেসক্লাব চত্বরে শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল এবং মোমবাতি প্রজ¦ালনের আয়োজন করা হয়েছে।
উপকূল অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও গবেষক শফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘উপকূলের মানুষ আজও বেঁচে আছে দুর্যোগের সঙ্গে লড়ে। একদিকে নদীভাঙন, অন্যদিকে জলোচ্ছ্বাসÑ সব মিলিয়ে তাদের জীবন অসহনীয়। তাই আমরা দীর্ঘদিন ধরে ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ ঘোষণার পাশাপাশি ‘উপকূল উন্নয়ন বোর্ড’ ও ‘উপকূল মন্ত্রণালয়’ গঠনের দাবি জানিয়ে আসছি।’

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন