*** হাওরের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় কমে গেছে মাছের ডিম পাড়ার জায়গা
*** ধানখেতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার মাছের প্রজনন ব্যবস্থার জন্য বড় হুমকি
দেশের মিঠাপানির মাছের অফুরন্ত ভা-ার হিসেবে পরিচিত হাওরাঞ্চলে এখন দেখা দিয়েছে তীব্র মাছের সংকট। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অসংখ্য দেশি প্রজাতির মাছ। মানবসৃষ্ট অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বৈদ্যুতিক শক মেশিন, নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারি জাল, জলমহাল ইজারাদারের বিষ প্রয়োগ এবং শুকনো মৌসুমে কৃষিজমিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে হাওরাঞ্চলের পরিবেশ ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। তারই প্রভাবে বিলুপ্তির পথে দেশের গুরুত্বপূর্ণ মিঠাপানির মৎস্যসম্পদ।
জানা গেছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলায় বিস্তৃত। জেলা শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। চারটি ইউনিয়নের ১৮টি মৌজাজুড়ে বিস্তৃত এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর। হাওরে ছোট-বড় বিল রয়েছে ৫৪টি, আর ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য খাল। বর্ষা মৌসুমে সব মিলিয়ে এটি এক বিশাল জলরাশিতে পরিণত হয়, যাকে স্থানীয়রা বলেন ‘সায়র’ বা ‘সাগর’। হাওরের ভেতর ও তীরবর্তী ৮৮টি গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা এই হাওরকেন্দ্রিক।
অতীত থেকেই টাঙ্গুয়ার হাওর দেশের অন্যতম বৃহৎ মিঠাপানির মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত। এখানকার মাছ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হতো। রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল, আইড়, বোয়াল, শোল, বাউশ, কৈ, শিং, পাবদা, চিংড়ি, গজার, পুঁটি, কেচকি, মলা, চাপিলা, ভেদেরা, বালিরাÑ এ রকম অসংখ্য প্রজাতির মাছের বিচরণস্থল ছিল এই হাওর। কিন্তু এখন এসব মাছের বেশির ভাগই বিলুপ্তির মুখে।
তথ্যমতে, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, ইজারাদারদের রাসায়নিক প্রয়োগ, নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার, বৈদ্যুতিক শক মেশিন এবং কৃষিজমিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে প্রায় ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর জমি ও জলাশয়ের জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
এ ছাড়া বিত্তশালী ব্যক্তিরা জেলে পরিচয়ে সমবায় সমিতি করে জলমহাল ইজারা নিচ্ছেন। তারা মুনাফার লোভে বিষ প্রয়োগ করে মাছ আহরণ করায় দ্রুত কমে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির মাছ। এতে প্রকৃত জেলে পরিবারের হাজারো মানুষ বেকার হয়ে পড়ছেন। একই সঙ্গে হাওরের স্বাভাবিক জলপ্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় মাছের ডিম পাড়ার স্থান কমে গেছে। দূষণের কারণে উৎপাদনও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, টাঙ্গুয়ার হাওরের আলাদা মাছ উৎপাদন তথ্য না থাকলেও ২০২১-২২ অর্থবছরে সুনামগঞ্জ জেলায় মোট মাছ উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৫১৭ টন। এর মধ্যে হাওরাঞ্চলের উৎপাদন মোট ৩২ হাজার ৯৬ টন দেখানো হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামসুল করিম বলেন, শুকনা মৌসুমে ধানখেতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার মাছের প্রজনন ব্যবস্থার জন্য বড় হুমকি। নিষিদ্ধ জাল, কীটনাশক, অপরিকল্পিত বাঁধ, পলি জমে জলাশয় ভরাট, নাব্য সংকট, এগুলো মাছ বিলুপ্তির একেকটা কারণ। ফলে মাছের নির্বিঘেœ চলাচল ও প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশি প্রজাতির মিঠাপানির মাছ পুরোপুরি বিলুপ্তির মুখে পড়বে। তিনি আরও বলেন, হাওরের মাছ শুধু জেলেদের জীবিকার উৎস নয়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গেও জড়িত। তাই পরিকল্পিত উন্নয়ন ও জনসচেতনতা বাড়ানো এখন অত্যন্ত জরুরি।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন