আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিগত দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলে ছিল উল্লষ্ফন। প্রতি বছরই পাসের হার আর জিপিএ-৫ আগের বছরের রেকর্ড ভাঙত। কিন্তু এবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় সেই ধারা থেকে বের হয়ে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে এবার ছিল না উদারনীতি। ফলে স্মরণকালের সেরা ধস নেমেছে ফলে। চলতি বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। যা আগের বছর ছিল ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। এবার সহানুভূতি মার্ক না দেওয়ার পাশাপাশি বরিশাল ও ময়মনসিংহ বোর্ডের ফলে ধস এবং মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের ফল খারাপ হওয়ার কারণে সার্বিকভাবে প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, এবার যারা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তারা ২০২০ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু সেবার কোভিডের কারণে তারা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস করতে পারেনি, অটোপাশে একের পর এক ক্লাসে উত্তীর্ণ হলেও লেখাপড়া হয়নি। এরপর নতুন শিক্ষাক্রমের ডামাডোলেও বিঘিœত হয় পড়াশোনা। সর্বশেষ, গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কারণেও পরীক্ষার আগে কয়েক মাস ক্লাস ও লেখাপড়া ছিল প্রায় বন্ধ। এ ছাড়াও চলতি বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষায় গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞানের প্রশ্ন ছিল অন্যবারের তুলনায় কঠিন। সবশেষে মূল্যায়নেও ছিল কড়াকড়ি। সবমিলিয়ে ধাক্কা লেগেছে পাসের হারে।
বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সাল থেকে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পর উত্তরপত্র মূল্যায়নে উদার চর্চা শুরু হয়। পরীক্ষার খাতায় লিখলেই যেন মার্ক দেওয়া হয় সেই নির্দেশনা ছিল পরীক্ষকদের প্রতি। অপ্রাসঙ্গিক উত্তর লিখলেও শিক্ষার্থীর নম্বর দেওয়ার প্রথা ছিল। ফলে পরীক্ষার খাতা ভর্তি করে লিখার পাশাপাশি প্রশ্নের উত্তর যত বড় লিখা হবে তত বেশি মার্ক দেওয়া হতো বলে জানিয়েছেন একাধিক পরীক্ষক ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা।
এ ছাড়াও কেউ ২৭ বা ২৮ পেলেও ৩৩ দিয়ে পাস করিয়ে দেওয়া হতো। এ ছাড়া গ্রেড পরিবর্তনের জন্য ২ থেকে ৫ মার্ক বেশি দেওয়ারও নির্দেশনা ছিল। এ কারণে বিগত সময়ে জিপিএ-৫ ও পাসের হার বেশি থাকলেও পড়াশোনার মান নিয়ে ছিল নানা প্রশ্ন। এবার সেই ধারা থেকে বের হয়ে এসেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। কাউকে দেওয়া হয়নি সহানুভূতির মার্ক। যে যত মার্ক পাবে তাকে তত মার্ক দেওয়ার নির্দেশনা ছিল বোর্ডগুলোর পক্ষ থেকে।
গতকাল পরীক্ষা ফল প্রকাশ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয়ক কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, এবার পাসের হার বাড়ানো বা কমানোর কোনো টার্গেট আমাদের ছিল না। এবার কোনো ধরনের বাড়তি নম্বর বা গ্রেস মার্কস কাউকে দেওয়া হয়নি। মেধার প্রকৃত মূল্যায়নের শতভাগ প্রচেষ্টা করা হয়েছে। পরীক্ষকদেরও সেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। ফলে যে ফল প্রকাশ করা হয়েছে সেটা প্রকৃত ও সত্য ফল। এ নিয়ে সন্দেহ-সংশয় ও ক্ষোভের সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, এবার ফল নিয়ে আমাদের ওপর মহল থেকে কোনো চাপ ছিল না। আমাদের বলা হয়েছে, যে রেজাল্ট হবে, সেটিই দিতে হবে। আমরাও পরীক্ষকদের এ অনুরোধ করেছি। তাদের যথার্থভাবে খাতা মূল্যায়নের জন্য বলা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা খাতায় যা লিখেছে, সে অনুসারে নম্বর পেয়েছে। শিক্ষার্থীদের খাতার প্রাপ্ত নম্বরই যথাযথভাবে আমরা কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রকাশ করেছি। কোনো নির্দিষ্ট নম্বর পাওয়ার পর বিশেষ নম্বর দিয়ে ভালো গ্রেড করে দেওয়া হয়নি। ফল তৈরিতে কোনো উদারনীতিও অবলম্বন করা হয়নি।
বরিশাল ও ময়মনসিংহে ফল বিপর্যয়
খাতা মূল্যায়নে উদারনীতি না থাকার পাশাপাশি বরিশাল ও ময়মনসিংহ বোর্ডে বিপর্যয় এবং মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা খারাপ ফল করার কারণে সার্বিক ফলের ওপর প্রভাব পড়েছে। ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছর বরিশাল বোর্ডে পাসের হার ৫৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ আর ময়মনসিংহ বোর্ডে পাসের হার ৫৮ দশমিক ২২ শতাংশ। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে বরিশাল বোর্ডে পাসের ৮৯ দশমিক ১৩ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৯০ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে ময়মনসিংহ বোর্ডে পাসের হার ৮৫ শতাংশ আর ২০২৩ সালে ছিল ৮৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এই বোর্ড ছাড়াও সব বোর্ডেই গত বছরের তুলনায় কমেছে পাসের হার।
বরিশাল বোর্ডে পাসের হার কমার বিষয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয়ক কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, বরিশাল অঞ্চলে খাল-বিলসহ প্রান্তিক এলাকা বেশি। এ অঞ্চলে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা একটু কঠিন হয়। এ ছাড়া আমরা ঢাকা মহানগরের বাইরে যত উপজেলা পর্যায়ে যাব, তত পাসের হার কমতে থাকে। কারণ ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা ফল ভালোর চেষ্টা করে সবসময়। তাই শহরের তুলনায় গ্রামের ফলে তারতম্য ঘটে।
বরিশাল বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউনুস আলী সিদ্দিকী বলেন, ৫ আগস্টের পর দেশে শিক্ষার একটা নতুন ধারা তৈরি হয়েছে। নতুন ধারার শিক্ষার মান কী অবস্থায় রয়েছে, আমরা সেটা জানার চেষ্টা করেছি। তাই এ বছর ফল খারাপ হয়েছে। আগামীতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার মান বাড়নোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, সামগ্রিকভাবে পাসের হার আশানুরূপ না হলেও শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে ছাত্রীদের ধারাবাহিক অগ্রগতি আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। আগামী দিনে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
মানবিক ও বাণিজ্যে ধরাশায়ী শিক্ষার্থীরা
বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রতিবারের মতো এবারও ভালো ফল করেছে। সে তুলনায় মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের ফল খারাপ হয়েছে। ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিজ্ঞানবিভাগে এবার পাসের হার ৮৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। মানবিকে এবার পাসের হার ৫৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ আর বাণিজ্য বিভাগে ৬৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। মানবিক বিভাগের মধ্যে গণিতে বেশি খারাপ করেছে শিক্ষার্থীরা।
ফলে দেখা যায়, এবার মানবিকে পাসের হারের মধ্যে ঢাকায় ৪৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ, রাজশাহীতে ৬৬ দশমিক ২০ শতাংশ, কুমিল্লায় ৪৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যশোরে ৬৪ দশমিক ৫১ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ, বরিশালে ৪৩ দশমিক ১৪ শতাংশ, সিলেটে ৬৪ দশমিক ৭১ শতাংশ, দিনাজপুরে ৪৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৪২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এরমধ্যে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে গণিতে পাস করেছে ৭৫ দশমিক ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। রাজশাহী বোর্ডে এ হার কিছুটা ভালোÑ ৮৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। যশোর বোর্ডেও তুলনামূলক ভালো ফল হয়েছে, পাসের হার ৮৫ দশমিক ০২ শতাংশ। তবে কুমিল্লা, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ বোর্ডে ফল অনেকটাই খারাপ। কুমিল্লা বোর্ডে গণিতে পাসের হার ৭২ দশমিক ১ শতাংশ, দিনাজপুর বোর্ডে ৭১ দশমিক ৩৫ এবং ময়মনসিংহ বোর্ডে মাত্র ৬৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। বরিশাল বোর্ডে এই হার আরও কম, মাত্র ৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। চট্টগ্রাম বোর্ডে গণিতে পাস করেছে ৮১ দশমিক ৫৩ শতাংশ শিক্ষার্থী, যা তুলনামূলকভাবে ভালো। সিলেট বোর্ডে গণিতে পাসের হার ৮৩ দশমিক ১৭ শতাংশ।
বিষয়ভিত্তিক ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বরিশাল বোর্ডে বাংলায় পাস করেছে ৯২ দশমিক ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে যথাক্রমে ৯২ দশমিক ১০ ও ৯১ দশমিক ৫১ শতাংশ শিক্ষার্থী কৃতকার্য হয়েছে। আইসিটিতে সবচেয়ে ভালো ফল, পাসের হার ৯৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। পৌরনীতি ও নাগরিকতায় ৮৯ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং অ্যাকাউন্টিংয়ে পাস করেছে ৮৬ দশমিক ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। কিন্তু ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের ফল বিপর্যয়ের চিত্র স্পষ্ট। ইংরেজিতে পাসের হার ৬৯ দশমিক ৬৬ এবং গণিতে আরও কমে ৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ, ইংরেজি ও গণিতের মতো মূল দুই বিষয়ের প্রতিটিতেই প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে।
এ ছাড়াও বাণিজ্য বিভাগে ঢাকায় ৬৭ দশমিক ১৫ শতাংশ, রাজশাহীতে ৭৯ দশমিক ২৫ শতাংশ, কুমিল্লায় ৫৩ দশমিক ৯২ শতাংশ, যশোরে ৭৯ দশমিক ১৭ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৭৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ, বরিশালে ৫৪ দশমিক ৬১ শতাংশ, সিলেটে ৭৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ, দিনাজপুরে ৬৮ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং ময়মনসিংহে ৫২ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।
বরিশাল বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ইউনুস আলী সিদ্দিকী বলেন, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে শিক্ষার্থীরা খারাপ করার কারণে পাসের হার কমেছে। এ জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দায়ী। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার মান বাড়ানোর তাগিদ খুব কম।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর শামছুল ইসলাম বলেন, এ বছর ফেল করা পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বেশির ভাগই গণিতে খারাপ করেছে। যে কারণে ফল কিছুটা খারাপ হয়েছে। তবে বিগত সাল থেকে এবার পরীক্ষা গুণগত ও মানসম্পন্ন হয়েছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, সাধারণত মানবিকে তুলনামূলক খারাপ শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। ফলে মানবিকের ফল একটু খারাপ হয়। আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা গণিত ভীতি রয়েছে। পাশাপাশি স্কুলে গণিত শিক্ষকের সংকট, মানসম্মত পাঠদানের অভাব এবং পর্যাপ্ত অনুশীলনের সুযোগ না থাকায় এমন ফল হচ্ছে।
সিলেট শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে অনেক শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হতে না পারায় পাসের হার কমেছে। বিশেষ করে মানবিক বিভাগে ফেল করা শিক্ষার্থীর হার বেশি। দুর্গম হাওরাঞ্চল ও গ্রামের অনেক প্রতিষ্ঠানে মানসম্পন্ন গণিত ও ইংরেজি শিক্ষকের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী প্রবণতা, অমনোযোগিতা এবং শিক্ষকদের সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবও খারাপ ফলের অন্যতম কারণ।