বাংলাদেশের উত্তরের জেলা নওগাঁ। আর এই জেলার পতœীতলা উপজেলায় অবস্থিত এক বিস্ময়কর জলাধার- আলতাদীঘি। শুধু একটি দীঘি নয়, এটি ঘিরে আছে কিংবদন্তি, ইতিহাস, প্রকৃতি ও পর্যটন সাথে রহস্যে ঘেরা এক অপূর্ব মেলবন্ধন। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর একটি, যার সৌন্দর্য ও রহস্য মুগ্ধ করে স্থানীয়দের পাশাপাশি প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে আগত ভ্রমণপিপাসুদেরও।
ইতিহাসের পাতায় আলতাদীঘি
আলতাদীঘির ইতিহাস প্রায় ১৫০০ বছর পুরোনো। বাংলার ইতিহাস একটা অধ্যায় আছে সেন শাসনের, সেই সেন শাসকদেরই স্মৃতি চিহ্ন এই আলতা দীঘি। জনশ্রুতি অনুযায়ী, রাজা বল্লাল সেন তার রানী আলতার নামে এই দীঘি খনন করেছিলেন। রানী আলতা একবার রাজাকে অনুরোধ করেন, প্রজাদের পানির কষ্ট দূর করার জন্য একটি বড় দীঘি খনন করতে। রাজা তখন নির্দেশ দেন এক রাতেই দীঘি খননের। অলৌকিকভাবে, রাতেই খনন সম্পন্ন হয় এবং সে থেকেই এর নাম হয় আলতাদীঘি।
প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের লীলাভূমি
আলতাদীঘি শুধুই একটি দীঘি নয়, এটি আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান হিসেবেও পরিচিত। এটি ২০১১ সালে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রায় ২৬৫ হেক্টর জমি নিয়ে বিস্তৃত এই এলাকা, যেখানে রয়েছে প্রাকৃতিক শালবন, নানা প্রজাতির গাছপালা, এবং বিভিন্ন পাখি, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণী। শীতে এখানে ভিড় জমায় অতিথি পাখিরা। কান পাতলে শোনা যায় অজানা ভাষায় ডেকে ওঠা শত শত পাখির কলতান। সন্ধ্যায় বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখা মেলে হরিণ কিংবা বনরইয়ের। প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এটি এক নিখুঁত স্বর্গরাজ্য। আলতা দীঘি তে প্রতি শীতকালে পিকনিক করার জন্য অনেক মানুষ ভিড় করে থাকেন।
আলতাদীঘিতে কি দেখবেন
দুই থেকে তিন মিনিট হেঁটে সামনে এগিয়ে একটি বাঁক নিয়ে অন্য বাঁকে পৌঁছাতেই দেখবেন গভীর বন আর অন্য পাশে গাছগাছালি, খেতের মাঝে সূর্যের আলো। পাশে বাঁশঝাড় একটু ভালো করে তাকাতেই দেখা যাবে দীঘির টলটলে জল ঢেকে রেখেছে বড় বড় সবুজ পাতায়। আর সেই বড় বড় পাতার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সাদা, গোলাপি পদ্মের দল! দেখেই চোখ জুড়িয়ে যাবে।
বিশাল আয়তনের এই দীঘিটি প্রায় ৪৩ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। দীঘির চারপাশে গাছপালা ও সবুজ ঘাসে ঘেরা পরিবেশ মন জুড়িয়ে দেয়। পাড়ে বসে জলরাশি ও সূর্যাস্ত উপভোগ করা এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। পাশেয় আছে আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান; এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক শালবন সংরক্ষণ এলাকা। এখানে রয়েছে শতাধিক প্রজাতির গাছ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও সরীসৃপ। পাখিপ্রেমীদের জন্য আদর্শ স্থান, বিশেষ করে শীতকালে অতিথি পাখিরা আসে। উদ্যানটি হাঁটার জন্য সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ। অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে বনভোজন করতে আসেন। শিশুদের জন্য খোলা জায়গা ও পরিবেশ উপযুক্ত। দীঘিতে নৌকা চালানো যায় (বিশেষত উৎসবকালে)। এতে করে পুরো দীঘির সৌন্দর্য কাছ থেকে উপভোগ করা যায়। স্থানীয় মানুষদের কাছে রাজার গল্প, রানী আলতার কাহিনি শোনান, যা খুব আকর্ষণীয়। দীঘির নামকরণ ও ইতিহাস ঘিরে প্রচলিত নানা মিথ-রূপকথা প্রচলিত আছে। দীঘির আশপাশে রয়েছে স্থানীয় বসতি ও কৃষিজীবী মানুষের জীবনযাত্রা। যারা শহুরে জীবনে অভ্যস্ত, তারা এখানে একেবারে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা পাবেন। আলতাদীঘির চারপাশের দৃশ্য ফটোগ্রাফারদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। পাখি, গাছ, পানির প্রতিফলন, সবই দারুণ চিত্র তৈরি করে।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে সড়কপথে নওগাঁ হয়ে পতœীতলা উপজেলা, সেখান থেকে খুব সহজেই যাওয়া যায় আলতাদীঘিতে। আপনি চাইলে রাজশাহী থেকেও যেতে পারেন। সড়কপথে নওগাঁ থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৩৫ কিলোমিটার।