লালন শাহের মাজার হলো মানুষের পুণ্যভূমি। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর মীর মোশারফ হোসেন। কবি-সাহিত্যিকদের কাছে এর চেয়ে উত্তম মনের খোরাক আর কিছু হয় না। মানে এক সঙ্গে তিন পুণ্যভূমি দর্শন লাভ। এসব দেখতে এক সকালে কুষ্টিয়ায় ছুটে যাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ী এবং লালন শাহের মাজারে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য। কাজের ব্যস্ততার চাপে যখন শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তখনই আমরা ছুটে যাই সেখানে। সেই সঙ্গে দেখা হয় মীর মোশারফ হোসেনের স্মৃতি চিহ্নটুকুও। মানে একের ভিতরে তিন! এই বর্ষাতেও ছুটেছিলাম।
ভরা বর্ষায় পদ্মা নদী ফুলে ফেঁপে ওঠে। আমাদের তবু ভয় ডর নেই। সেই বিশাল বিশাল ঢেউ পাড়ি দিয়েই আমরা যেতে চাই। জীবনে ভ্রমণে তো রোমাঞ্চই দরকার সবার আগে। পাবনা থেকে কুষ্টিয়া সড়ক পথেও যাওয়া যায়। তবে সে বেশ ঘুরপথ আর বিরক্তিকর। তার থেকে নদীপথই ঢের ভালো। পদ্মা পাড়ি দিলেই কুষ্টিয়ায় পৌঁছানো যায়। সময়ও খুব কম লাগে। আমার সঙ্গে পাবনার কবি আদ্যনাথ ঘোষ, কবি গোবিন্দলাল হালদার এবং টাঙাইলের অতিথি কবি এমরান হাসান ছিলেন। লালন সাঁইয়ের গানে তিন পাগলে জমে মেলা আর আমরা হলাম চার পাগল। তো মেলা তো খারাপ জমার কথা না। বিশাল নৌকায় নিজেকেই কেমন রবীন্দ্রনাথ মনে হচ্ছিল! তিনি তো এই নদীতেই বজরায় চেপে কত সাহিত্য সাধনা করেছেন। নৌকা থেকে নেমেই একটি অটো নিয়ে সোজা কুঠিবাড়ীর দিকে যাত্রা করি। সেখানে পৌঁছে দেখি বেশ অনেক পর্যটক এসেছেন।
কেউ দেখছেন আবার কেউ সেলফি তুলছেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮০৭ সালে রামলোচন ঠাকুরের উইলসূত্রে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর এ জমিদারির মালিক হন। রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে প্রথম শিলাইদহে আসেন ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে। সে হিসেবে আজ থেকে ১২৪ বছর আগে কবির প্রথম পদচারণা পড়েছিল এই বাড়িতে। তিনি ১৯০১ সাল পর্যন্ত এখানে জমিদারি পরিচালনা করেছিলেন। প্রায় ১১ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই কুঠিবাড়ি। টিকিট নিয়ে প্রবেশ করতেই মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। আমার শরীরজুড়ে খেলে গেল শিহরণ। টিকিট দিয়ে কক্ষের ভেতর প্রবেশ করলাম। নিচতলার প্রতিটি কক্ষেই রয়েছে কবিগুরুর বিভিন্ন সময়ের বয়সের ছবি। বিভিন্ন বয়সের এত ছবি একসঙ্গে দেখে চোখে ঘোর লাগে। তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তোলা স্মৃতি, কবির হাতে আঁকা ছবি, নিজ হাতে লেখা চিঠি ।
তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর ছবি দেখলাম। এবার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। সেখানে প্রতিটি কক্ষে রয়েছে কবির কক্ষে ব্যবহৃত সামগ্রী। কবির ব্যবহৃত বজরার একটি নমুনা রাখা আছে এখানে। ছিন্নপত্রের একটি পাতা এবং হাতে লেখা একটি ইংরেজি চিঠি পড়ে দেখলাম। দুটি পালকি রয়েছে। এর একটি ষোলো বেহারার পালকি আর একটি আট বেহারার পালকি। কবি নিজে এগুলো ব্যবহার করতেন। চোখের সামনে ভেসে উঠল একদিন এই কবি প্রাঙ্গণে পালকির বেহারার কণ্ঠ ভেসে বেড়াতো। পালকির ভেতর থেকে নেমে আসতেন কবি। এ ছাড়াও বাকি সব কক্ষে রয়েছে আলনা, কাঠের বড় টেবিল, হাতলযুক্ত চেয়ার, খাট সোফা, ল্যাম্প স্ট্যান্ড, ইত্যাদিসহ কবির ব্যবহৃত বহু জিনিস। বাইরের বারান্দায় রয়েছে কবির ব্যবহৃত ইঞ্জিনচালিত স্পিডবোট। সামনে দাঁড়ালেই এক নজরেই পুরো কুঠি বাড়ি দেখা যায়। এখানে কবির বহু বিখ্যাত লেখা রচিত হয়েছে।
এখানে বসেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘সোনার তরী’, ‘শৈশব সন্ধ্যা’, ‘উর্বশী’, ‘দিন শেষে’, ‘দুই বোন’, ‘আবেদন’, ‘মানস সুন্দরী’, ‘নববর্ষা’, ‘আষাঢ়’, ‘বিরহ’, প্রভৃতি বিখ্যাত সব কাব্যগ্রন্থ। নাটকের মধ্যে ‘চিরকুমার সভা’, ‘গোড়ায় গলদ’ (প্রহসন), ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘রাজা’, ‘অচলায়তন’। ছোটগল্পের মধ্যে ‘কঙ্কাল’, ‘শান্তি’, ‘সমাপ্তি’, ‘ফেল’ ইত্যাদি। পদ্মার বুকে ভ্রমণের সময়ও তিনি বহু সাহিত্য, গান রচনা করেছিলেন। কুঠিবাড়ির চারদিকে লোকালয় হলেও এখনো খুব একটা ব্যস্ততা দেখলাম না। বাইরে যেমনই থাকুক ভেতরে ঢুকলেই এক ধরনের নীরবতা, প্রশান্তি। সবাই যেন কবির ঘোরে হারিয়ে যায়। একপাশে রয়েছে বিশাল অডিটরিয়াম। দর্শনার্থীরা আসছেন, বিশ্রাম নিচ্ছেন।
ঘুরে ঘুরে দেখছেন কবির স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহের কুঠিবাড়ি। সেই সঙ্গে সাহিত্যপ্রেমীরা খুঁজছেন সেদিনের সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সময় শেষ। আমরা তিনজন কুঠিবাড়ি থেকে বেরিয়ে চললাম লালন সাঁইয়ের মাজারে। মনটা কেমন যেন উদাস হয়েই ছিল। এবার যেন মাজারে পৌঁছাতেই তা পূর্ণতা পেল। কি আশ্চর্য শান্তির অনুভূতি।’ সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’- যে মানুষটি পড়ালেখা না জেনেই জ্ঞান ভান্ডারের পূর্ণতা পেয়েছেন, যার অনুভূতির কাছে বিশ্ব মোহময় জগতে আবিষ্ট সেই মানুষটির চির শয়নের স্থানটি দেখে বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। কে ছিলেন লালন? লালন একাই একটি পৃথিবী ছিল। বিশ্বব্যাপী তার কত শত ভক্ত, অনুসারী।
আজকের রাজনীতিবিদরা যেখানে পয়সা দিয়ে মানুষ টানেন সেখানে তিনি সব হারা হয়েও পাগলের মতো মানুষ টেনে চলেছেন। সত্যি তিনি মানুষ তো! সাধক না হলে এত ক্ষমতা কোথায় মানুষের। মাজারে প্রবেশের শুরুতেই আপনাকে স্বাগত জানাবে একটি বিশাল হাতসহ একতারা। যে একতারার সুরে বাউল মন জেগে ওঠে। বাউল হতে ইচ্ছে করে। মাজার কমপ্লেক্সে সাঁইজিসহ মোট ৩২টি সমাধি আছে। এর মধ্যে ১৪টি সাঁইজির মুরিদ, ১ জন প্রশিষ্য আর বাকি তার অনুসারীদের। পাশেই রয়েছে সংগ্রহশালা। সেখানে দর্শনার্থীরা ঘুরে ঘুরে দেখছেন বাউলদের সেই সময়ে ব্যবহৃত নানা জিনিস। অনেক বাউল ভক্ত এসেছেন। তারা একতারা হাতে সুর তুলেছেন। আমাদেরও মন মজে গেল।
তাই বসে খানিকটা সময় গান শুনলাম। দরাজ কণ্ঠে সুর তুললেন,’ জলের ওপর পানি না পানির উপর জল’। এই যে আজ পৃথিবীতে ধর্মে ধর্মে এত হানাহানি সত্যি তো এর মূলে আসলে কি কিছু আছে? না সবটাই মানুষের স্বার্থে? পাশেই একটি হোটেলে নদীর মাছ দিয়ে দুপুরের খাবার পর্ব সারলাম। তারপর রওনা হলাম গাজী মিঞার ভিটার উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌঁছালাম মীর মোশারফ হোসেন স্মৃতি পাঠাগার ও অডিটোরিয়ামে। লেখকের স্মৃতিগুলো দেখলাম। মনে হলো কিছুটা অবহেলাজুড়ে আছে এখানে। ভেতরের ছবি তোলা নিষেধ। ফলে লগ বইয়ে স্মৃতিকথা লিখে আবার রওনা হলাম পদ্মার উদ্দেশ্যে। নৌকায় কানে ভেসে এলো কেউ গাইছে’ ও পদ্মার ঢেউ রে...।
অলোক আচার্য
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
পাবনা
মোবাইল: ০১৭৩৭ ০৪৪৯৪৬
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন