টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার শিমলাপাড়া মৌজায় অবস্থিত হেমনগর জমিদার বাড়ি বা স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ‘পরীর দালান’। এই ঐতিহাসিক প্রাসাদ আপনাকে নিয়ে যাবে ১৮৯০ সালের এক হারিয়ে যাওয়া যুগে। কালের সাক্ষী হয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই বিশাল প্রাসাদটি অতীত দিনের গল্প শোনায়। হেমচন্দ্র চৌধুরী নামে হিন্দু জমিদার এই বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজের নামানুসারে গ্রামের নামকরণ করে হেমনগর রাখেন। একসময় এই বাড়ি ছিল তাদের প্রশাসনিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের কেন্দ্র। জমিদার পরিবার শিক্ষার প্রসারে বিশেষ ভূমিকা রাখতেন।
স্থাপত্য ও বিশেষত্ব
হেমনগর জমিদার বাড়ি তার মনোমুগ্ধকর স্থাপত্যের জন্য পরিচিত। প্রধান আকর্ষণ হলো ভবনের ছাদে থাকা দুইটি পরীর ভাস্কর্য, যা প্রায়শই দর্শনার্থীদের প্রথম নজর কেড়ে নেয়। প্রায় ৩০ একর বা তারও বেশি জমির ওপর নির্মিত এ প্রাসাদে প্রায় একশ’ কক্ষ ছিল। দিল্লি ও কলকাতার দক্ষ কারিগরদের হাতে নির্মিত বাড়িতে চিনি টিকরী অলংকরণ রয়েছে। এতে কাঁচ ও ভগ্নাংশের ব্যবহার করে নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা এখনো দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। দ্বিতল এই প্রাসাদে ছিল দরবার হল, অন্দর মহল, দুই সারি বারান্দা এবং প্রশস্ত দেয়ালবেষ্টিত চতুর্ভুজাকার কাঠামো। প্রাসাদের সামনে বিস্তৃত মাঠ, চিড়িয়াখানা, নাট্যমঞ্চ বা জলসাঘর, পূজাম-প, হাতিশালা এবং দুটি বড় পুকুর ছিল। এসব কিছুই বাড়িটিকে এক অনন্য ঐতিহাসিক চিত্র উপস্থাপন করে।
এক ঝলকে ইতিহাস
হেমনগরের জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর পিতা কালীচন্দ্র চৌধুরী সূর্যাস্ত আইনের আওতায় শিমুলিয়া পরগনার জমিদারি কিনেছিলেন। হেমচন্দ্র চৌধুরী প্রথমে ১৮৮০ সালে সুবর্ণখালি গ্রামে একটি রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। কিন্তু যমুনার ভাঙনে তা বিলীন হয়ে যায়। এরপর ১৮৯০ সালে শিমলাপাড়া মৌজায় নতুন করে দৃষ্টিনন্দন পরীর দালান নির্মাণ করেন। জমিদার পরিবার শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। প্রাসাদের ভেতরে নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিক্ষামূলক কার্যক্রম এবং সামাজিক মিলনায়তন অনুষ্ঠিত হতো। সেই সময়ের রাজপরিবার ও জমিদার পরিবারদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি আজও এই বাড়ির নিঃশব্দ দেয়াল থেকে বোঝা যায়।
লোককথা
লোকমুখে বলা হয়, জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর রাজপ্রাসাদের ছাদে যে দুইটি পরীর ভাস্কর্য আছে, তারা কেবল স্থাপত্যশিল্প নয় স্থানীয়রা মনে করে এই দুই পরী রাতের বেলায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। কাহিনি অনুসারে ভাস্কর্যগুলো কখনো কখনো হেমনগরের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। যারা রাতের বেলা প্রাসাদের আশপাশে যায়, তারা পরীদের নীরব হাসি বা সাদা ধোঁয়ার মতো ছায়া দেখতে পায়। শিশুদেরকে বলা হয়, যারা প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে গলিতে দুষ্টুমি করে, তারা পরীর চোখে ধরা পড়ে। কিছু মানুষ মনে করে, এই পরীরা পরিবারের সন্তানদের রক্ষা করে এবং জমিদার বাড়ির শান্তি বজায় রাখে। স্থানীয়দের ধারণা অনুযায়ী, এই পরীর কাহিনিই স্থাপত্যের নামকরণে প্রভাব ফেলেছে ‘পরীর দালান’ নামের উত্থান এই লোককাহিনি থেকে।
যেভাবে যাবেন
হেমনগর জমিদার বাড়ি পরিদর্শন করতে প্রথমে টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলায় পৌঁছাতে হবে। গোপালপুর সদর থেকে প্রায় ৯-১৫ কি.মি. পশ্চিমে অবস্থিত হেমনগর গ্রামে রাজবাড়িটি। ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, সিএনজি বা অটো-গাড়িতে যাওয়া যাবে। গোপালপুর বা ভূঞাপুর উপজেলা থেকেও সরাসরি যাওয়া যায়। পর্যটকরা চাইলে একদিনের ভ্রমণে হেমনগরসহ কাছাকাছি গ্রামীণ পরিবেশ ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরে দেখার পরিকল্পনা করতে পারেন।
বর্তমান অবস্থা
প্রাসাদটি বর্তমানে জীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তবে মূল ভবনটি এখন হেমনগর ডিগ্রি কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় সম্পূর্ণ বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পদচারণায় ভবনটি জীবন্ত ও মুখরিত। যদিও অনেক অংশই পুরোনো রং ও কারুকাজ হারিয়েছে, তবুও প্রাসাদের মৌলিক স্থাপত্য ও পরিবেশ এখনো দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।
কি দেখবেন
পরীর দালান ও তার ছাদের ভাস্কর্য, শত কক্ষের বিশালতা, চিনি টিকরী অলংকরণ এবং অন্যান্য কারুকার্য, প্রাসাদের চারপাশের মাঠ, পুকুর ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহ্য ও স্থাপত্যপ্রেমী পর্যটকদের জন্য হেমনগর জমিদার বাড়ি এক অপরিহার্য গন্তব্য।
হেমনগর জমিদার বাড়ি শুধু একটি প্রাসাদ নয়। এটি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের জীবন্ত সাক্ষ্য। যারা ইতিহাসে আগ্রহী, গ্রামীণ পরিবেশে সময় কাটাতে চান এবং পুরোনো স্থাপত্যের সৌন্দর্য অনুধাবন করতে চান তাদের জন্য হেমনগর একটি স্বপ্নের গন্তব্য।
এটি যে কোনো ভ্রমণপ্রেমীর তালিকায় থাকা উচিত। একবার হেমনগর দর্শন করলে সেই প্রাচীন রাজবাড়ির গল্প, স্থাপত্যের অনন্যতা এবং শান্ত পরিবেশ ভুলে যাওয়া কঠিন।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন