ঢাকা বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০২৫

হোম ডেলিভারি হচ্ছে সুন্দরবনের হরিণের মাংস

বাগেরহাট প্রতিনিধি
প্রকাশিত: জুলাই ১৬, ২০২৫, ০২:২৮ এএম
সুন্দরবনের হরিণ। ছবি- সংগৃহীত

বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুম হিসেবে জুন থেকে আগস্ট- এই তিন মাস সুন্দরবনে পর্যটক, জেলে ও বাওয়ালিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও থামছে না হরিণ শিকার। এরই মধ্যে স্থানীয় প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে একাধিক হরিণ শিকারি চক্র, যারা নিয়মিতভাবে হরিণ শিকার করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছে এমনকি চালু করেছে ‘হোম ডেলিভারি’ পরিষেবাও।

গত ৬ মাসে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন ৬০০ কেজি হরিণের মাংস, ৮টি চামড়া এবং ২০০টি ফাঁদ উদ্ধার করেছে। আটক করা হয়েছে ২০ জন শিকারি। এছাড়াও পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ ১ মাসে উদ্ধার করেছে ২ হাজার ৬১৫টি হরিণ শিকারের ফাঁদ, আটক ১২ জনের বিরুদ্ধে করা হয়েছে ১২টি মামলা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হরিণশিকারি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘অনেক জেলে ও বাওয়ালিই মাছ ধরার পারমিট নিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে সুযোগ বুঝে হরিণ শিকার করেন। তাদের বলা হয় ‘সুযোগসন্ধানী’ শিকারি। অন্যদিকে, সংঘবদ্ধ চক্রগুলো নিয়মিতভাবে পরিকল্পিতভাবে শিকার চালিয়ে যায়।

হরিণ শিকারি সলেমান শেখ বলেন, ‘হরিণ শিকারের পর মাংস গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রয়েছে পৃথক দল। তাদের প্রধান ক্রেতা স্থানীয় উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবার। প্রতি কেজি মাংসের দাম ৮০০ থেকে শুরু করে দূরত্ব ও পরিমাণ ভেদে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়।’

সলেমান আরও বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে শূকর বা কুকুরের মাংস হরিণের নামে বিক্রি করা হয়। তবে বর্তমানে সচেতন ভোক্তারা চামড়ার অংশসহ মাংস কিনতে চান।’

শিকারিরা নাইলনের সুতা, স্প্রিং বসানো ফাঁদ, কলায় ঝোলানো বড়শি, চেতনানাশক ও গুলি ব্যবহার করে হরিণ শিকার করে। সুন্দরবনের দুবলার চর, হিরণ পয়েন্ট, কটকা, তালপট্টি, চরখালি, কচিখালি, রসুলপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সবচেয়ে বেশি হরিণ শিকার হয়।

মাংস পাওয়া যায় সুন্দরবনসংলগ্ন মোংলার চিলা, জয়মনি, কাটাখালী, মোরেলগঞ্জের গুলিশাখালী, সন্ন্যাসী, শরণখোলার ধানসাগর, তাফালবাড়ী, রামপালের বেশ কিছু গ্রামে হরিণের মাংস বিক্রি করা হয়।

আইইউসিএন-এর ২০২৩ সালের জরিপ অনুযায়ী, সুন্দরবনে বর্তমানে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টি হরিণ রয়েছে। ২০০৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার, অর্থাৎ ১৯ বছরে বেড়েছে প্রায় ৫৪ হাজারটি।

এদিকে এসব হরিণ দেখাশোনার জন্য পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে ১ হাজার ৫০০ একর বনভূমির জন্য রয়েছে মাত্র একজন বনকর্মী, পদ শূন্য ১০০টি। আউটসোর্স কর্মীদের দিয়ে অস্ত্র চালানো যায় না। তবু ঈদের ছুটিতেও অভিযান চালিয়েছেন বনরক্ষীরা।

বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘হরিণ শিকারের ফাঁদ জমা দিলে প্রতি কেজি ফাঁদের জন্য ২ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।  এরই মধ্যে ৮ জনকে নগদ অর্থ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।’

এছাড়া চরদুয়ানি ও জ্ঞানপাড়া এলাকায় স্থানীয়দের নিয়ে দুটি ১০ সদস্যের স্বেচ্ছাসেবক কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বাগেরহাট জেলা সভাপতি নূর আলম শেখ বলেন, ‘শিকার বন্ধে বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়াতে হবে এবং আইন আরও কঠোর করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শুধু শিকারি নয়, যারা মাংস খান, তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করাও জরুরি। শিকার বন্ধ হলে হরিণ বাড়বে, আর হরিণ বাড়লে বাঘও টিকবে।’