ঢাকা শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

অব্যাহত নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা

হাসিবুল ইসলাম, বরিশাল
প্রকাশিত: জুলাই ৯, ২০২৫, ০৪:৫১ এএম
বরিশালের কীর্তনখোলা-আড়িয়াল খাঁসহ কয়েকটি নদীর অব্যাহত ভাঙনে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে রয়েছেন মানুষ। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

বরিশাল শহর লাগোয়া কীর্তনখোলা-আড়িয়াল খাঁসহ কয়েকটি নদীর অব্যাহত ভাঙনে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে রয়েছেন ২০ লক্ষাধিক মানুষ। প্রতিবারের মতো এবারও বর্ষা মৌসুমে নদীগুলোতে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য বাড়িঘরসহ একাধিক স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ জেলা প্রশাসনের দুয়ারে একাধিকবার কড়া নেড়েও কোনো প্রতিকার না পেয়ে সর্বশেষ রাজপথে নেমেছেন ভাঙনকবলিত এলাকাসমূহের মানুষজন।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় ক্ষুব্ধ নদীতীরের বাসিন্দারা ভাঙনরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়ে বরিশালে কয়েকবার মানববন্ধন করেছেন। কিন্তু এরপরেও নদীভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড বা সরকারের অপরাপর দপ্তরগুলোর কার্যকরী কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি, যা নিয়ে সাধারণ মানুষকে হতাশ করেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বরিশাল সদর উপজেলার শায়েস্তবাদ ইউনিয়নের দক্ষিণ আইচা (রামকাঠি) গ্রামের বিশাল একটি অংশ নদীতে বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। কয়েক বছরের ক্রমাগত ভাঙনে প্রায় দুই কিলোমিটার জনপদ নদীগর্ভে চলে গেলেও নতুন করে ভাঙনরোধে এই এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ড শক্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

বছর দুয়েক পূর্বে অনুরূপ ভাঙন দেখা দিলে এলাকাবাসী একজোট হয়ে বরিশাল সদর আসনের সাবেক এমপি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের স্মরণাপণ্ন হলে তিনি জরুরিভিত্তিতে বেশকিছু কাজ করেন। ওই সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা ভাঙনরোধে স্থায়ী ব্যবস্থাগ্রহণের অভয় দিলেও শেষ পর্যন্ত তা আর বাস্তবায়ন হয়নি।

রামকাঠি গ্রামের জামাল মীরসহ একাধিক বাসিন্দা জানান, বিগত সময়ের তুলনায় এবার আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙন ব্যাপক আকারে পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত সাতদিনের ব্যবধানে অন্তত ৫০০ মিটারের বেশি রাস্তাঘাট ফসলি ভূমি নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙন ঝুঁকিতে থাকা অন্তত শতাধিক পরিবার ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়াসহ নিরাপদ আশ্রয় চলে গেছেন। এখনও যাদের ঘরবাড়ি নদীর কাছাকাছি রয়েছে, তারা ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন, কখন সর্বনাশা নদী সবকিছু কেড়ে নেবে।

পার্শ্ববর্তী চরবাড়িয়া ইউনিয়নের লামছড়ি গ্রামের অবস্থা আরও ভয়াবহ। এই গ্রামের প্রধান সড়কসহ কয়েক হাজার বাড়িঘর গত কয়েক বছরে কীর্তনখোলা নদীতে বিলীন হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড দুই বছর আগে নদীতীরে ব্লক ফেললে কিছু এলাকা রক্ষা পেলেও এখনও মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কয়েক দিনের নদীভাঙন রীতিমত জনসাধারণের মনে ভীতি ধরিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে আধা কিলোমিটারের বেশি ফসলি ভূমি নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙনে বিলীন হয়েছে বেশকিছু স্থাপনাসহ জনগুরুত্বপূর্ণ সড়ক।

এখনো গ্রামটির অন্তত অর্ধশত ঘরবাড়ি, স্কুল-মসজিদ-মাদ্রাসা ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে, যা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে একাধিকবার অবহিত করা হয়। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্যণীয় নয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সবশেষ ইউনিয়নবাসীর ব্যানারে বরিশাল শহরে একাধিকবার মানববন্ধনও করা হয়।

আড়িয়াল খাঁ নদীর বাবুগঞ্জ অংশেও ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের শিকারপুর ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় বেশি মাত্রায় ভাঙতে শুরু করেছে। কয়েক দিনের ভাঙনে ব্রিজের আশপাশ এলাকার ফসলি জমিসহ বেশকিছু স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন আতঙ্কে অসংখ্য ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই অব্যাহত ভাঙন ব্রিজটিকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

জানা গেছে, আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙনে পার্শ্ববর্তী মুলাদী উপজেলার সফিপুর ইউনিয়নের ভেদুরিয়া থেকে ঘুলিঘাট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার জায়গা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এতে ভিটেমাটি হারিয়েছে চার শতাধিক পরিবার। জয়ন্তী নদীতে উপজেলার মৃধারহাট, ষোলঘর, ভেদুরিয়া, বাটামারা, আলীমাবাদ এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছু জায়গায় জিও ব্যাগ ফেলেও ভাঙন রোধ করতে পারছে না।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, উপজেলার আড়িয়াল খাঁ ও জয়ন্তী নদীর ব্যাপক ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে ১০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাট-বাজার। ভাঙন রোধে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া না গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বিলীন হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এছাড়া বরিশালের বানারীপাড়া, উজিরপুর, বাকেরগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলায় ব্যাপকভাবে নদীভাঙনের খবর পাওয়া গেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাসে নদীভাঙন কবলিত অন্তত ৪০টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় ২০ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। তাই এসব স্থানসমূহকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভাঙন রোধে একটি প্রকল্পও তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত বরাদ্দ না পাওয়ায় নদীভাঙন রোধে কার্যকরী ব্যবস্থাগ্রহণ করা যাচ্ছে না।

তবে এই নদীভাঙন রোধে এতদিনেও উদ্যোগ নিতে না পারায় পানি উন্নয়ন বোর্ডকেই দুষছেন জনসাধারণ। তাদের অভিযোগ, গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরও নদীভাঙন রোধে পদক্ষেপ নিতে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে একাধিকবার ধর্না দেওয়া হয়। কিন্তু তারা শুধু দেখি, দেখছি করে সময়ক্ষেপন করেছেন। এখন যখন অব্যাহত নদীভাঙন শুরু হয়েছে, তখন বলছেন পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই, যা তামাশার সামিল বলে মন্তব্য পাওয়া যায়।

নদীভাঙন কবলিতদের মধ্যে ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয় বলে মন্তব্য করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল।

এই কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, তিনি দায়িত্বগ্রহণ করেছেন কয়েক মাস হয়েছে। যোগদানের পরপরই তিনি বরিশাল সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার নদীভাঙন কবলিত ৪০ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করেছেন এবং সেগুলো প্রকল্প আকারে তৈরি করে ঢাকায় পাঠিয়েছেন।

আশা করা যায়, কিছুদিনের মধ্যেই বরাদ্দ চলে আসবে, এরপরে পর্যায়ক্রমে তালিকা ধরে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহে ভাঙনরোধে কাজ করা সম্ভব হবে, জানান তিনি।