অযত্ন-অবহেলায় খুঁড়িয়ে চলছে এক সময়ের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ গাজীপুর সাফারি পার্ক। প্রতিনিয়ত কমছে দর্শনার্থীর সংখ্যা। গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনা ইউনিয়নের ইন্দ্রপুর এলাকায় ৪ হাজার ৯০৯ একর ভূমির মধ্যে ৩ হাজার ৮১৯ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠে সাফারি পার্ক। ছোট ছোট টিলা ও শালবন সমৃদ্ধ এ পার্কটি থাইল্যান্ডের সাফারি ওয়ার্ল্ডের আদলে ২০১৩ সালে চালু হয়। এর অন্যতম আকর্ষণ কোর সাফারি।
পুরো পার্কটি স্কয়ার, কোর সাফারি পার্ক, বায়োডাইভার্সিটি পার্ক, সাফারি কিংডম এবং এক্সটেনসিভ এশিয়ান সাফারি পার্ক—এই পাঁচটি অংশে বিভক্ত। ঢাকা ও আশপাশের মানুষ পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসলেও বর্তমানে অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে প্রাণী মৃত্যু, স্থাপনা নষ্ট হওয়া এবং অসচেতন ব্যবস্থাপনায় দিন দিন কমছে দর্শনার্থী।
জানা যায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় পার্কটিতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। মূল ফটক, শেখ মুজিবুর রহমানের মুরাল, প্রাণী জাদুঘর, পাখিশালা, পার্ক অফিসসহ বিভিন্ন খাদ্যের দোকান ভাঙচুর করা হয়। লুট হয় দোকানের মালামাল, বৈদ্যুতিক মোটর, সিসি ক্যামেরা, চেয়ার, টেবিলসহ নানা সরঞ্জাম। ক্ষতিগ্রস্ত হয় পার্ক অফিসের সব কক্ষের জানালা-দরজা, রেস্ট হাউসের জানালা ও দুটি পর্যবেক্ষণ জিপ গাড়ি। প্রায় তিন মাস পর দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় পার্কটি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পার্কে জেব্রা, ওয়াইল্ডবিস্ট, জলহস্তী, ময়ূর, অজগর, কুমির, হাতি, বাঘ, ভালুক, সিংহ, হরিণ, লামচিতা, শকুন, কচ্ছপ, রাজধনেশ, কাকধনেশ, ঈগল, সাদা বক, রঙিলা বক, সারস, কাস্তেচরা, মথুরা, নিশিবক, কানিবক, বনগরু, গুইসাপ, শজারু, বাগডাশ, মার্বেল ক্যাট, গোল্ডেন ক্যাট, ফিশিং ক্যাট, খ্যাঁকশিয়াল ও বনরুইসহ শতাধিক প্রজাতির প্রাণী থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে সংখ্যা অনেক কম।
এখন রয়েছে মাত্র ১টি জিরাফ, ৪২টি জেব্রা, ১১টি ওয়াইল্ডবিস্ট, ৭টি বাঘ, ৪টি সিংহ, ২২টি ভালুক, ২ শতাধিক হরিণ, ১১টি গয়াল, ৯টি নীলগাই, ৫টি সাম্বার হরিণ, ৩টি কমন ইলন, ১৫টি মায়া হরিণসহ হাতি, ঘোড়া, মেকাও, ময়ূর, ময়না, শকুন, ধনেশ, মদনটাক, প্যালিক্যানসহ কয়েক প্রজাতির প্রাণী, পাখি ও সরীসৃপ। তবে শিশু পার্কসহ বেশ কয়েকটি স্থান দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ।
ভেতরে কোর সাফারির চার কিলোমিটার সড়কে বিশেষ বাসে দর্শনার্থীরা বাঘ, সিংহ, ভালুকসহ আফ্রিকান প্রাণী দেখেন। কিন্তু ওই সড়কের তিন কিলোমিটার জুড়ে কাদা-পানি, খানাখন্দ আর দেবে যাওয়া রাস্তার কারণে ঝুঁকি নিয়ে চলছে বাসগুলো। ফলে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা হতাশ হচ্ছেন।
অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মে প্রাণী মৃত্যুর পাশাপাশি রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগও রয়েছে। ২০২১ সালে তিনটি ক্যাঙারু মারা যাওয়ার পর থেকে পার্কটি ক্যাঙারুশূন্য। একই বছর মারা যায় একটি সিংহ ও একটি ওয়াইল্ডবিস্ট। ২০২২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে মারা যায় ১১টি জেব্রা, একটি বাঘ ও একটি সিংহ। ২০২৩ সালের অক্টোবরে মারা যায় একটি জিরাফ। এছাড়া ব্ল্যাক ও হোয়াইট সোয়ান একসময় লেকগুলো ভরিয়ে রাখলেও বর্তমানে একটিও নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পার্কের এক কর্মচারী জানান, দীর্ঘদিন ধরেই চলছে অনিয়ম। দলবদ্ধভাবে স্কুল-কলেজ থেকে দর্শনার্থী এলে অনেক টিকিটের হিসাব মিলছে না। এ ছাড়া গাইড পরিচয়ে এক শ্রেণির দালাল দর্শনার্থীদের বাড়তি টাকার বিনিময়ে ঘোরাচ্ছে, যা রাজস্ব ফাঁকির অন্যতম কারণ।
ঢাকা থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা ফাইজা বলেন, ‘পার্কের ভেতরে অনেক কিছু অব্যবস্থাপনায় পড়ে আছে। হরিণের বেষ্টনীতে খাবার নেই, ঘোড়া শুকিয়ে গেছে। প্রাণীগুলোর যত্নে অবহেলা স্পষ্ট। দর্শনার্থীদের বসার জায়গা বা ওয়াকওয়ে ভালো নেই। পরিকল্পনা করে পরিচর্যা করলে জায়গাটি সুন্দর হতে পারত।’
আরেক দর্শনার্থী মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘প্রত্যেকটি প্রাণী যেন অগোছালো অবস্থায় আছে। অনেক খাঁচা ফাঁকা। যে বাঘটা দেখলাম, সেটিও রোগা। অজগরও অবহেলায় পড়ে আছে। সবচেয়ে কষ্টের বিষয়, কয়ার্প মাছগুলো ঘোলা পানিতে কচুরি পানায় ঢাকা।’
পার্ক গেটের বাইরে তিন ভাই টাটকা খাবার হোটেলের মালিক আবুল কালাম বলেন, ‘এখন আর দর্শনার্থী আসে না বললেই চলে। শুধু শুক্রবার কিছু মানুষ আসে। বাকি দিন দোকান বন্ধ রাখতে হয়। ব্যবসা একেবারে মন্দা।’
দায়িত্বে থাকা বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোন কথা বলবো না, আপনি বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) শারমীন আক্তার স্যারের সঙ্গে কথা বলেন।’
এ বিষয়ে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) শারমীন আক্তারের ফোন একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন