ঢাকা শনিবার, ০৪ অক্টোবর, ২০২৫

ভাত না খেয়ে ৬০ পার

কাপাসিয়া (গাজীপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২৫, ০২:৩০ পিএম
শামসুদ্দিন। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

যেখানে ভাত ছাড়া বাঙালির একবেলাও কল্পনা করা যায় না, সেখানে জন্মের পর থেকে একবারের জন্যও ভাত, পোলাও, বিরিয়ানি ও খিচুড়িসহ এ ধরনের খাবারগুলো মুখে দেননি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার টোক ইউনিয়নের ঘোষেরকান্দি এলাকার মৃত ছবিরউদ্দিনের ছেলে শামসুদ্দিন।

এসব না খেয়েও অন্যদের চেয়ে সুস্থ জীবনযাপন করছেন তিনি। তার বর্তমান বয়স ৬৫ বছরের ওপর।

তিনি ১৯৬২ সালে ঘোষেরকান্দি গ্রামোর রাবুর বাড়ি (জেবুর আলী) নানাবাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। শামসুদ্দিন ১৯৭৮ সালে টোক রনেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ১৯৮০ সালে এইচএসসি পাস করেন। ৫ ভাই ৩ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। তার জন্ম থেকে এ পর্যন্ত সপরিবারে বেড়ে ওঠা নানাবাড়িতে। তিনি ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) অফিসে দিনাজপুরের চিরির বন্দর উপজেলা অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি করতেন। চাকরিরত অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনার কারণে হাতে আঘাত পেয়ে চাকরি ছেড়ে দেন।

ঘোষেরকান্দি গ্রামের প্রবীণ ও বয়স্ক আব্দুল সাত্তার, তোতামিয়া ও মোর্শেদ জানান, শামসুদ্দিন ছোটকাল থেকেই ভাত পছন্দ করেন না। ভাত খাওয়া তো দূরের কথা, ভাত দেখলে বা ভাতের গন্ধ তার নাকে এলেই বমি করে দেন। তারা তাদের মুরুব্বিদের কাছে শুনেছেন, তার জন্মের পর তিনি যখন একটু বড় হন তখন তার মা-চাচি-ফুপুরা তাকে ভাত খাওয়ায় অভ্যস্ত করে তুলতে মুখে ভাত দিলে সে খেতে পারত না, সাথে সাথে বমি করে দিত।

শামসুদ্দিনের বাড়ির প্রবেশপথে একই গ্রামের বিজয় মন্ডলের ছেলে বিপুল বলেন, চাচা তো ভাত, খিচুড়ি, পোলাও ছাড়া সবই খান। চাচাকে তারা নানাভাবে এমনকি টাকা-পয়সার লোভ দেখিয়েও ভাত খাওয়াতে পারেননি। শামসুদ্দিনের ছোট ভাই জালাল উদ্দিনের ছেলে সুজনসহ এলাকার একাধিক বয়োজ্যেষ্ঠরা একই কথা বলেন। বাড়ির ও পরিবারের সদস্যদের ভাত খাবার সময় তিনি বেশির ভাগ সময়ই ঘরের বাইরে থাকেন। আর বাড়িতে থাকলেও অন্য ঘরে দরজা বন্ধ করে রাখেন যাতে ভাতের গন্ধ তার নাকে না যায়।

যেখানে মানুষ বাইরের ফাস্ট ফুড থেকে শুরু করে বাহারি খাবার খেয়েও ভাত খাওয়া ছাড়া থাকতে পারে না সেখানে শামসুদ্দিন দীর্ঘ ৬০ বছর ভাত না খেয়েও দিব্যি সুস্থ জীবনযাপন করছেন।



শামসুদ্দিন বলেন, ভাত আমার চিরশত্রু। ভাত দেখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। ভাত খাওয়া তো পরের কথা, ঘ্রাণ পেলেই বমি আসে এবং তখন মনে  হয় এই বুঝি আমি মারা যাচ্ছি। আর ভাতের প্রতি তার আলাদা একটা ঘৃণা জন্মেছে বলেও তিনি জানান। ভাত পোলাও, খিচুড়ি এ জাতীয় খাবারগুলো তার জীবনের শত্রুর মতো লাগে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি আরও বলেন, ছোটবেলা মা তাকে ভাত খাওয়ানোর অভ্যেস গড়ে তুলতে চাইলেও ব্যর্থ হন। কারণ ভাত মুখের সামনে নিলেই বমি হতো। কোনো অবস্থায় তাকে ভাত খাওয়ার অভ্যেস করাতে পারেনি মা-বাবা। তিনি শৈশবে ভাত না খাওয়ায় মা-বাবা, পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনরা খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। পরে একজন বিজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে শামসুদ্দিনের ভাত না খাওয়ার বিষয়ে কথা বলেন, ডাক্তার তখন শামসুদ্দিনের মা-বাবাকে পরামর্শ দেন, সে যখন ভাত বা ভাত জাতীয় কোনো খাবার খেতে চায় না এমনকি ঘ্রাণ পেলেই বমি হয় তা হলে তাকে তার মতো খেতে দেন। আরও বলেন, সে যেটা খেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে সেটা খেয়েই জীবন ধারণ করতে কোনো রকম অসুবিধা হবে না। সেই থেকে শামসুদ্দিনের ভাত খাওয়া বন্ধ। আজ পর্যন্ত ভাত না খেয়ে দিব্যি সুস্থ জীবনযাপন করছেন। 

শামসুদ্দিন জানান, আত্মীয় বা কারো বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াতে গেলে তিনি আটার রুটি তৈরি করে সাথে নিয়ে যান এবং ওই অনুষ্ঠানে রান্না করা মাছ, মাংস ও সবজিসহ যেকোনো তরকারি দিয়ে আলাদাভাবে বসে খাবার খেয়ে থাকেন।  তার নিজের বাড়িতে তার খাবারের জন্য  প্লেট-গ্লাস-বাটিসহ সবকিছু আলাদা। কারণ ভাতের ব্যবহারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তার সামনে আসলেই তার বমির ভাব হয়।

একজন মানুষ জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত ভাত,  পোলাও, খিচুড়িসহ এ জাতীয় খাবার না খেলে তার শরীরে কোনো রকম সমস্যা হবে কি না- এ বিষয়ে কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হাবীবুর রহমান বলেন, একজন মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে ধান জাতীয় অর্থাৎ চাল থেকে যে পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট প্রয়োজন তা ভাত থেকেই  নিতে হবে এমনটা না। চাল জাতীয় খাবার ভাত, পোলাও, বিরিয়ানি ও খিচুড়িসহ যে খাবারগুলো রয়েছে তা না খেলেও কোনো রকম সমস্যা হবে না। ভাত জাতীয় খাবারের পরিবর্তে চাল থেকে তৈরি পিঠা, মুড়ি, চিড়াসহ অন্যান্য খাবার নিয়মিত খেলেও তিনি ভাত জাতীয় খাবারের সমপরিমাণ কার্বোহাইড্রেট পাবেন। অতএব ভাত জাতীয় খাবার না খেলেও তার কোনো রকম সমস্যা হবে না।