খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজারে এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার পর গত রোববার থেকে বিক্ষোভ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে সারা জেলায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। যা আজ মঙ্গলবারেও বহাল রয়েছে।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত এই বিধিনিষেধ বহাল থাকবে।এদিকে জেলাজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। অবরোধকারীরা সড়ক অবরোধ করলেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঘটনার সূত্র
এর আগে গত মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাতে এক স্কুলছাত্রীকে গুইমারার রামেসু এলাকায় দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ ওঠে। পরে ওই কিশোরীকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় ওই কিশোরীর বাবা মামলা দায়ের করেন।
মামলা দায়েরের পর সেনাবাহিনীর সহায়তায় অভিযুক্ত শয়ন শীলকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাকে আদালত ছয় দিনের রিমান্ড দিয়েছেন।
এদিকে ধর্ষণের প্রতিবাদে স্থানীয় জুম্ম ছাত্র-জনতা আন্দোলন শুরু করে। বিক্ষোভ একপর্যায়ে সহিংসতায় পরিণত হয় যা পরবর্তীতে রামেসু বাজারে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মাধ্যমে ঘটতে থাকে।
রামেসু বাজারে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ
গত রোববারের সহিংসতায় রামেসু বাজারের অর্ধশতাধিক দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। দোকানপাটের পাশাপাশি আশপাশের ঘরবাড়ি ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে তিনতলা একটি ভবন, যেখানে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, সমাজসেবা কার্যালয়, পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়, মহিলাবিষয়ক কার্যালয়, তথ্য আপা কার্যালয়, খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, ক্লিনিকসহ প্রায় ১৫টি অফিস পুড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২ কোটি টাকার বেশি।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, সহিংসতায় অনেক সময় মুখোশ পরা ব্যক্তি এসে লুটপাট চালিয়েছে এবং পরিকল্পিতভাবে অগ্নিসংযোগ করেছে। এতে স্থানীয় জনগণের জীবিকা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি গভীর।
নিহত ও আহত
সহিংসতার সময় গুলিতে গুইমারা উপজেলার তিন যুবক নিহত হন। তারা হলেন আথুই মারমা (২১), আথ্রাউ মারমা (২২) ও তৈইচিং মারমা (২০)। তাদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে এবং মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আহতদের চিকিৎসা চলমান।
অবরোধ ও যান চলাচল পরিস্থিতি
জুম্ম ছাত্র-জনতা ডাকা অবরোধের কারণে খাগড়াছড়ির সদর ও গুইমারা উপজেলায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। সোমবার দুপুর থেকে অবরোধ কিছুটা শিথিল হওয়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের পথে যান চলাচল শুরু হলেও, রাঙামাটির সঙ্গে যোগাযোগ এখনো বন্ধ রয়েছে। জেলা সদর থেকে অন্য ৯ উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ থাকার ফলে জীবনযাত্রায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে। জরুরি সেবা ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করছে না।
প্রশাসনের উদ্যোগ
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও অন্যান্য কর্মকর্তা জুম্ম ছাত্র-জনতার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আন্দোলনের ৮ দফা দাবি তুলে ধরা হয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে দ্রুত বিচার, নির্যাতন ও গ্রেপ্তার বন্ধ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং অবরোধ প্রত্যাহার। প্রশাসন বেশ কিছু দাবি মানার আশ্বাস দিয়েছে, তবে অবরোধ উঠানো না হলে ১৪৪ ধারা শিথিল হবে না।
অন্যদিকে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ভারত ও ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অভিযোগ করেন। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক শীর্ষ নেতার ‘ভুয়া ধর্ষণ’ মন্তব্য নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক প্রতিনিধি পদত্যাগ করেছেন। পরে ওই নেতা এই মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
রাঙামাটির অবস্থা
রাঙামাটিতে সড়ক অবরোধের প্রভাব তেমন পড়েনি, যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। তবে রাঙামাটি থেকে খাগড়াছড়ি ও মারিশ্যার রাস্তাগুলো এখনো বন্ধ রয়েছে।
এদিকে রাঙামাটির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথাযথ বজায় রাখতে মাঠে আছেন সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার ভিডিপি সদস্যরাসহ সব পাহাড়ি বাঙালি রাজনৈতিক দলের নেতারা। সবার একটাই ভাষ্য খাগড়াছড়ির বাতাস যেন রাঙামাটিতে না বয়। পাহাড়ি বাঙালি সবাই রাঙামাটিতে শান্তি চায়।
অন্যদিকে রাঙামাটি রিজিয়ন কমান্ডার, সদর জোন কমান্ডার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও পাহাড়ি বাঙালি রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেন, গুটি কয়েকজন লোক খাগড়াছড়ির পরিবেশ অশান্ত করে তুলেছে। আমরা চাই না খাগড়াছড়ির অশুভশক্তি রাঙামাটিতে এসে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে। এখানে পাহাড়ি বাঙালি সবাই মিলেমিশে এক সঙ্গে বসবাস করতে চাই। কেউ গুজবে কান দেবেন না। ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়ানো ছিটানো মিথ্যা তথ্য শেয়ার করবেন না। রাঙামাটির প্রশাসন কঠোর অবস্থানে আছেন। অন্যায় দেখলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। না বুঝে না শুনে কোন খবর বা মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য ফেইসবুকে শেয়ার করবেন না।
রাঙামাটি শহরে আদালত পাড়া, জেলা প্রশাসন কার্যালয়, কলেজগেইট, এসপি অফিস,বাণিজ্যিক কেন্দ্র বনরুপা, রিজার্ভ বাজার, তবলছড়ি, মানিকছড়ি, পৌরসভা এলাকার সবকয়টি পুজামণ্ডপে কড়া নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
এছাড়াও শহরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নিরাপত্তার বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। শহরের মধ্যে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিজিবি টহল দিতে দেখা গেছে। জেলার ১০ উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্তক অবস্থায় ছিলেন। সবাই শান্তির পথে সভা ও মতবিনিময় করছেন।