খুলনার পাইকগাছা পৌরসভায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে জনবসতি এলাকায় প্রকাশ্যে কাঠ পুড়িয়ে চিংড়ি মাছ শুকানোর ঘটনায় চরম ক্ষোভ ও ভোগান্তিতে পড়েছে এলাকাবাসী। ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষণ, বায়ু দূষণ ও জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি হলেও প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে এ অবৈধ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পৌরসভার ৬ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডে কামাল হোসেন ও দেবব্রত মিলে বাড়িঘরের মাঝখানে, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় শত শত মন দেশীয় কাঠ পুড়িয়ে চিংড়ি মাছ শুকাচ্ছেন। আমাবশ্য ও পুর্ণিমায় দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশ ঢেকে রাখে, চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে যায়। এতে একদিকে পথচারীরা শ্বাসকষ্টে ভোগেন।
অন্যদিকে স্থানীয় ঘরবন্দি সাধারণ মানুষ চরম কষ্টে দিন পার করছেন। এ ঘটনায় এলাকাবাসী অভিযোগ করলেও প্রতিকার পায়নি।
স্থানীয়রা জানান, সরকারি অনুমোদন বা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই জনবসতির মধ্যে এ অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। চিংড়ি শুকানোর কাজে তারা কাঠের পাশাপাশি কেরোসিন তেল ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করেন, যা থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ধারা ৬(ক) অনুসারে, যেকোনো শিল্প বা বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন সনদ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। আইন অমান্য করলে দণ্ডবিধি অনুযায়ী জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
তদুপরি, বায়ু দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০২৩ অনুযায়ী জনবসতি এলাকায় কাঠ বা অন্য কোনো বায়ুদূষণকারী জ্বালানি ব্যবহার করে শিল্প বা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে কামাল হোসেন ও জানান, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছি। কেউ কিছু বলেনি।’
স্থানীয় সচেতন নাগরিক কবির হোসেন বলেন, ‘আমাদের এলাকার বাচ্চারা ধোঁয়ায় কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভুগছে। ঘরের ভেতরেও ধোঁয়ার গন্ধে থাকা যায় না। আমরা বহুবার মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছি, কিন্তু কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি।’
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, চিংড়ি শুকানোর সময় কাঠে কেরোসিন তেল ব্যবহার করলে তাতে থাকা রাসায়নিক উপাদান চিংড়ির মধ্যে প্রবেশ করে। এসব মাছ নিয়মিত খেলে ফুসফুস, লিভার ও কিডনি জটিলতা, এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়তে পারে।
পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহেরা নাজনীন বলেন, ‘লোকালয়ে কাঠ পুড়িয়ে মাছ শুকানো সম্পূর্ণ অবৈধ ও পরিবেশবিরোধী। বিষয়টি আমরা জেনেছি, প্রয়োজনীয় তদন্ত করে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এদিকে, উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগও জানিয়েছে ধোঁয়ার কারণে এলাকায় শ্বাসযন্ত্রের রোগ ও অ্যালার্জির প্রকোপ বাড়ছে। তারা প্রশাসনকে অবিলম্বে এ কার্যক্রম বন্ধে উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দিয়েছেন।
খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মমতাজ বেগম বলেন, পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া কেউ এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। অভিযোগ পেলে পরিদর্শন করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয় বাসিন্দারা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, ‘সরকার যেখানে পরিবেশ রক্ষায় ব্যাপক পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেখানে জনবসতির মধ্যে কাঠ পুড়িয়ে মাছ শুকানো শুধু আইন ভঙ্গই নয়, জনগণের জীবনের ওপরও ভয়ানক হুমকি। আমরা দ্রুত এ অবৈধ কার্যক্রম বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ চাই।’
সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ বা শুকানোর মতো কার্যক্রম শিল্প এলাকা বা নির্ধারিত ফুড প্রসেসিং জোনে, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পরিচালনা করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু পাইকগাছার এই ব্যবসায়ীরা সেই নীতিমালা অমান্য করে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য উভয়ের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ করে টেকসই ও স্বাস্থ্যসম্মত বিকল্প প্রক্রিয়া চালু না করলে স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রা ও পরিবেশ উভয়ই বিপন্ন হবে।
সচেতন মহল ও স্থানীয় প্রশাসন একযোগে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে, পাইকগাছা শহরের বাতাসই একদিন মানুষের জন্য বিষাক্ত হয়ে উঠবে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা।


সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন