ঢাকা বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫

মুজিব শতবর্ষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

এইচ এম সাগর (হিরামন), বটিয়াঘাটা (খুলনা)
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০২৫, ১১:১৪ পিএম
সুরখালী ইউনিয়নের রায়পুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ভেঙে পড়েছে। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

বটিয়াঘাটা উপজেলার মুজিব শতবর্ষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, ঘর বিক্রি-ভাড়া দেওয়া, প্রশাসনের অসহযোগিতা এবং দায়িত্বহীনতার কারণে পুরো প্রকল্পই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন উপকারভোগী ও স্থানীয়রা।

সরকারি নথি অনুযায়ী, বটিয়াঘাটার সাতটি ইউনিয়নে বিভিন্ন ধাপে মোট ৭৪৬টি ঘর নির্মাণের জন্য ১৯ কোটি ৪ লাখ ৩৮ হাজার ২০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রথম থেকে পঞ্চম পর্যায় পর্যন্ত ঘর নির্মাণে কোটি কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হলেও বাস্তবে ঘরগুলোর গুণগতমান নিয়ে প্রবল অসন্তোষ রয়েছে উপকারভোগীদের মধ্যে।

নিম্নমানের সামগ্রী, দ্রুত ভেঙে পড়ছে ঘর

উপকারভোগীদের অভিযোগ, প্রতিটি ঘরের জন্য দেড় লাখ থেকে ৪-৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেখানো হলেও বাস্তবে খরচ হয়েছে মাত্র দেড় থেকে দুই লাখ টাকা।
ঘরগুলোর কোথাও নিম্নমানের ইট-বালু, কোথাও ভাঙা কাঠ, কোথাও নিম্নমানের সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। 

রায়পুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ভেঙে পড়েছে এবং পারাপারের জন্য নেই ব্যবস্থা। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

ফলে অনেক ঘর নির্মাণের কয়েক মাসের মধ্যেই দেয়াল ফেটে যাওয়া, মেঝে ধসে পড়া, বৃষ্টির পানি ঢুকে বসবাস অনুপযোগী হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। কয়েকটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর এখনও পানির নিচে তলিয়ে আছে।

উপকারভোগী রেবেকা, রথীন, মহসিন ও কুদ্দুসসহ অনেকে জানান, ঝড়-বৃষ্টি হলে ঘরে থাকার সাহস পাই না। যেকোনো সময় ভেঙে পড়বে, এই ভয়ে আতঙ্কে থাকি।

ঘর কেনাবেচা ও ভাড়ায় দেওয়ার অভিযোগ

সরেজমিন অনুসন্ধানে বটিয়াঘাটার জলমা, সুরখালী, বালিয়াডাঙ্গা ও অন্যান্য ইউনিয়নের একাধিক প্রকল্পে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় ঘর কেনাবেচার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জলমা ইউনিয়নের তেঁতুলতলা দশগেট এলাকায় নির্মিত ১৬০টি ঘরের মধ্যে ৩০-৪০টি ঘর বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। একই এলাকায় জেসমিন আক্তার (ঘর নং ১০০), আরেকজন উপকারভোগী (ঘর নং ৯৯)সহ আরও নয়জন নিজেদের ঘর বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন।

ঘর কিনে প্রতারণার শিকার হওয়া নয়জন আদালতে মামলা করলে একজন অফিস সহকারী সুজন, বহিরাগত জুলেখা ও সাইফুলকে আসামি করা হয়। জুলেখা ও সাইফুলকে গ্রেপ্তার করা হলেও সুজন অন্যত্র বদলি হয়েছেন বলে জানা যায়।

রায়পুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর হেলে পড়েছে এবং ঘরগুলোতে পানি উঠে গেছে। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

মাথাভাঙ্গা এলাকায় ২০০টি ঘরের মধ্যে ২০-২৫টি ঘর বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। বালিয়াডাঙ্গার বিরাট এলাকাতেও একাধিক ঘর হাতবদল হয়েছে—মোজাফফর মল্লিক, বিলকিস বেগম, নুর ইসলাম ও মুরছানিল তাদের ঘর বিক্রি করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এক ক্রেতা মাহাতাব হোসেন বলেন, ‘টাকায় ঘর কিনেছি, কিন্তু এখনো কোনো কাগজপত্র পাইনি।’

স্থানীয় সাংবাদিক সোহরাব হোসেন মুন্সী বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতি এতটাই স্পষ্ট যে সরকারের টাকা হরিলুট হয়েছে—এটা বলাই যায়।’

প্রশাসনিক অফিসে তালবাহানা

আশ্রয়ণ প্রকল্পের তথ্য সংগ্রহে গিয়ে সাংবাদিকরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এসিল্যান্ড কার্যালয়ে চরম হয়রানির শিকার হন। কেউ দায়িত্ব এড়িয়ে যান, কেউ বলেন নথি পাওয়া যাচ্ছে না, কেউ বলেন দায়িত্ব পেয়েছেন অল্প দিন—কিছুই জানেন না।

কর্তৃপক্ষ যা বলছে

বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবু বকর মোল্লা বলেন, ‘আমার কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

রায়পুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর হেলে পড়েছে। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. শোয়েব শাত-ঈল-ইভান বলেন, ‘ঘর নির্মাণের সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তবে অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হবে এবং অনিয়ম প্রমাণিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থান্দার কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমি সদ্য দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। তদন্তের মাধ্যমে সবকিছু যাচাই করা হবে।’

স্থানীয়দের দাবি

‘মুজিব বর্ষের ঘর গৃহহীন মানুষের স্বপ্ন ছিল, কিন্তু এখন তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে’—জানান রায়পুর আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকার ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন।
স্থানীয়দের দাবি, স্বচ্ছ তদন্ত, সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা ও ভেঙেপড়া ঘরগুলোর দ্রুত পুনর্নির্মাণ প্রয়োজন।