রবিবার (৫ অক্টোবর) দিবাগত রাত সাড়ে ১১টা। ঘুমন্ত মানুষগুলোর অজান্তে শান্ত দুধকুমার আকস্মিক রুদ্ররূপ ধারণ করল। হঠাৎ শুরু হওয়া ভাঙনে ডান তীরের মাটি নদের পানিতে আছড়ে পড়ার শব্দে ঘুম ভাঙে গ্রামবাসীর। ততক্ষণে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রান্নাঘর. টিউবয়েল, বাড়ির সীমানাপ্রাচীর, আবার কারো-বা ভিটার অংশ নদের গর্ভে বিলীন হতে শুরু করেছে। জীবন বাজি রেখে রাতের অন্ধকারেই নারী-পুরুষ সকলে মিলে বসতঘর ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরানোর কাজ শুরু করে। দিনের আলো ফুটতেই ভাঙনের তীব্রতার সাথে দুর্গতদের কর্মযজ্ঞ বাড়ে। গাছ কেটে নেওয়া, ঘর ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে এগিয়ে আসেন গ্রামবাসী ও আত্মীয়-স্বজন।
রবিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার দিনভর কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের দুধকুমার নদের তীরবর্তী বানিয়াপাড়া ও মুন্সিপাড়া গ্রামের চিত্র ছিল এমনই। ভাঙনের তীব্রতায় ৫০টিরও বেশি পরিবার বাস্তুহারা, নিঃস্ব। তারা কোথায় যাবেন, পরিবার নিয়ে কীভাবে বসতি গড়বেন সে চিন্তায় দিশেহারা। এখনও ভাঙন হুমকিতে দাঁড়িয়ে আছে আরও অসংখ্য পরিবার।
শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে ভাঙনকবলিত গ্রাম দুটিতে গিয়ে দেখা যায়, তখনও বাড়িঘর ও আসবাবপত্র সরাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন ভাঙনকবলিতরা। কেউ ঘর সরাতে ব্যস্ত আবার কেউ-বা গাছ কেটে সরিয়ে নিচ্ছেন। নারী-পুরুষ কিংবা শিশু কারোরই যেন ফুরসত নেই। দুধুকুমারের ক্ষুরধার স্রোতের তোড়ে নদীগর্ভে যাচ্ছে বসতভিটা। পরম যত্নে গড়া বসতির এভাবে বিলীন হওয়ার দৃশ্য হাহাকার নিয়ে দেখছেন বাসিন্দারা।
২ ছেলে ৪ মেয়েকে নিয়ে পরিবার বানিয়া পাড়ার বিধবা নারী আফিয়া বেওয়ার। দুধকুমারের আগ্রাসী ভাঙনে একটি ঘরের বেড়া, চালসহ ধাপড়ি চলে গেছে নদীগর্ভে। আরেকটি ঘরের বেড়া ও চাল সরিয়ে রেখেছেন অন্যের জমিতে। ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চারিদিকে। অবশিষ্ট একটি ঘরে গাদাগাদি করে ভাঙন আতঙ্ক নিয়ে রাত্রি যাপন করছেন আফিয়া ও তাঁর সন্তানেরা।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আফিয়া বেওয়া বলেন, "বাপো আমার বাড়ি, ঘর, দুয়োর ভাংগি সোগ চুরমার করি ফেলাইছে নদী। একটি ঘর নদীত চলি গেইছে। খাম, খড়ি কিচ্ছু পাই নাই। সোগ কিছু এলোমেলো করি রাখছি। আমার যাওয়ার কোন জায়গা নাই। কটাই যে যামো তার কোন কুল-কিনারা নাই।"
তিনি আরও বলেন, "দুইটে যে খাম থোমো তারও বুদ্দি নাই। মানুষও পাওয়া যায় না। যার যার ধরি তাই তাই কান্দাকাটি। কারটা কাঁই ধরে? কোদি যে গেইছে কোন জিনিস তার কোন অস্তি চাম নাই। মাইনষের গাছ গাছালি, বাড়ী, ঘর, দুয়োর সোগ কিছু গেইছে।"
আফিয়া বেওয়ার মতো একই পরিস্থিতি ওই গ্রামের আরেক নারী আমেনা বেগমেরও। আমেনা বেগম বলেন, "একটা ঘর ভাংগি গেইছে নদীর মদ্দে। আর একটা ঘর নিয়ে য্যায়া ওত্তি থুইছি। এলা কটাই যে যামো তার কোন নির্দিষ্ট নাই। এলা কটাই যে আল্লাহ নিয়ে যাওয়াইবে! কটাই য্যায়া যে পাশর বান্দি!"
দুধকুমারের ক্রমাগত ভাঙনে সমস্ত আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে নিঃস্ব পার্শ্ববর্তী মুন্সিপাড়া গ্রামের জাকির হোসেন। জাকির হোসেন বলেন, "নদী ভাংতে ভাংতে দাদার রেখে যাওয়া ৬ থেকে সাড়ে ৬ বিঘা আবাদী জমি নদীতে চলে গেছে। এখন আমি নিঃস্ব।"
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, "অনেকে এসে বলেন নদী ভাংগন রোধে কাজ হবে। কিন্তু আশ্বাসই দেয় যা, কাজ আর হয় না! আমাদের আর কোন উপায় নেই! আমরা এখন একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি! কষ্টে জীবনযাপন করা লাগবে, এই আর কি!"
দুদিন আগেও মুন্সিপাড়া গ্রামে বসতি ছিল দিনমজুর রফিকুল ইসলাম এর। এপাড়ায় তার ছিল আধাপাকা দালান বাড়ি ঘর। দুটি পরিবার থাকতেন একটি ভিটায়। কিন্তু দুধকুমারের ভাঙনের কবলে পরে তার আধাপাকা বিল্ডিংটিও বিলীন হয়েছে।
দিনমজুর রফিকুল ইসলাম বলেন, দুধকুমারের ভাঙনে আমার আধাপাকা বিল্ডিং বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এখন আমি নিঃস্ব। কোথায় যাবো জানি না!
জরুরি ভিত্তিতে ভাঙনরোধে কর্তৃপক্ষকে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর বলেন, "এখানে স্কুল, মাদরাসা, মসজিদ সহ যাত্রাপুর হাট রয়েছে৷ যাত্রাপুরহাটে অসংখ্য মানুষ ব্যবসা বানিজ্য করেন। এবং সরকার রাজস্ব পায় এ হাট থেকে। ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়া হলে যাত্রাপুর হাট ভাঙনের হুমকিতে পরতে পারে। এতে করে এ এলাকার মানুষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি সরকারও এ হাটের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে।"
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, "কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের বানিয়া পাড়া এলাকায় দুধকুমার নদের ভাঙন রোধের জন্য ইতিমধ্যে সেখানে ১২ হাজার জিওব্যাগ দেয়া হয়েছে। আরও কিছু দেয়ার চেষ্টা চলছে। বরাদ্দ পেলে আরও দেয়া হবে।"
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন