লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের কাকিনা বাসস্ট্যান্ডের পাশে রয়েছে কবি শেখ ফজলল করিম স্মৃতি গণপাঠাগার। পাঠাগারের দরজায় ঝুলছে তালা, ফটকের দুই পাশে দোকানপাট বসানো, আর ভেতরে-বাইরে আবর্জনার স্তূপ। পাঠাগারের ভগ্নপ্রায় ভবনটিতে নেই রংয়ের ছোঁয়া, ঝুলন্ত সাইনবোর্ডটিও আজ মলিন।
২০০৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারটি এখন পড়ে আছে ব্যবস্থাপনার অভাবে বন্ধ অবস্থায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের এক স্থানীয় নেতার অবহেলা ও রাজনৈতিক অনিচ্ছার কারণে পাঠাগারটি কার্যত পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। ফলে কবির স্মৃতিচিহ্নগুলোও হারিয়ে যাওয়ার পথে।
কবির বাড়ি ও স্মৃতিচিহ্ন
পাঠাগার থেকে অল্প দূরেই কবি শেখ ফজলল করিমের জন্মভিটা, যেখানে আজও কবির ব্যবহৃত কিছু জিনিস সংরক্ষিত আছে—চেয়ার, খাট, টুপি, দোয়াত-কলম, ছোট্ট কুরআন শরিফ, ম্যাগনিফায়িং গ্লাস ও বোতাম। এগুলোর অধিকাংশই সংরক্ষণের অভাবে নষ্টের পথে। দর্শনার্থীদের জন্য নেই বসার জায়গা, নেই কোনো তথ্যসংবলিত বোর্ড কিংবা গাইড। শুধু জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে খোলা হয় তার ঘরের তালা।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কবি স্মৃতি পাঠাগারের পাশ দিয়ে মহাসড়ক থেকে নেমে যাওয়া সড়ক ধরে ভেতরের দিকে খানিকক্ষণ হাঁটলেই ‘কবিবাড়ি’। বাড়ির উঠানের একপাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন শেখ ফজলল করিম। টিনশেডের আধাপাকা বাড়ির একটি কক্ষে এখনো রয়েছে কবির কিছু স্মৃতিচিহ্ন, যেগুলো যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে প্রায় নষ্টের উপক্রম। সেখানে রয়েছে কবির ব্যবহৃত চেয়ার, খাট, ব্যবহৃত টুপি, দোয়াত-কলম, ছোট্ট কুরআন শরিফ, ম্যাগনিফায়িং গ্লাস ও কিছু বোতাম। কবির টানে দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটক এলে বাড়িতে থাকা কবির একজন নাতবউ কিছু সময়ের জন্য ঘরটি খুলে দেন। সেখানে নেই দর্শনার্থীদের জন্য সামান্য বসার ব্যবস্থাটুকুও। কবির স্মৃতি বা বাড়িটি দেখভালের মতো উল্লেখ করার মতো কেউ নেই সেখানে।
স্থানীয়রা জানান, পাঠাগারটি একসময় খোলা ছিল, কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা আবার বন্ধ হয়ে যায়।
কাকিনা বাজারে ব্যাবসা করেন কবির নাতির ছেলে শেখ ফিরোজ। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত থেকে প্রচুর মানুষ কবির বাড়িতে এখনো আসেন। কবির তিন প্রজন্ম শেষ হয়ে গেছে। এখন আমরাও লোকের অভাবে কবির স্মৃতি রক্ষা করতে পারছি না। এজন্য সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।’
আক্ষেপ করে কবির এই বংশধর বলেন, ‘ফজলল করিমের বিখ্যাত কবিতা ‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক’ একসময় পাঠ্যবইয়ে ছিল। কিন্তু পরে সেটি তুলে দেওয়া হয়। পুনরায় পাঠ্যবইয়ে কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।’
কবি পরিবারকে সহ্য করতেন না আওয়ামী লীগ নেতা তাহু
অভিযোগ রয়েছে, কাকিনা ইউনিয়ন পরিষদের পলাতক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা তাহির তাহু কবি শেখ ফজলল করিম স্মৃতি গণপাঠাগারের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। গত প্রায় ১৬ বছরে ওই এলাকার সবকিছুতেই ‘দাদাগিরি’ করতেন তিনি। কিন্তু সভাপতি হয়েও পাঠাগার চালু কিংবা কবির স্মৃতি রক্ষায় নেননি কোনো উদ্যোগ। স্থানীয় ‘নাজির’ পরিবারের সন্তান তাহু পূর্বসূরিদের মতোই কখনো কবি পরিবারকে সহ্য করতেন না। ফলে কবি প্রসঙ্গে তিনি ছিলেন উদাসীন।
স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা বলেন, ‘স্থানীয় কয়েকজনের উদ্যোগে বেশ কয়েক বছর আগে কবি স্মৃতি পাঠাগারটি বছরখানেক খোলা ছিল। পরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় সেটি আবারও বন্ধ হয়ে যায়। এখন দখল-দূষণে দিন দিন পাঠাগারটিও যেন পরিত্যক্ত হয়ে পড়ছে।’
কবির স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা ও জাদুঘর তৈরির দাবি
স্থানীয় কলেজ শিক্ষার্থী ও সংস্কৃতিকর্মী আহেদুল ইসলাম আদেল রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘কবির জন্ম ও মৃত্যুদিবসে মাঝেমধ্যে হয়তো ছোটখাটো কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় স্থানীয়ভাবে। এরপর আর কেউ খোঁজ রাখে না। লালমনিরহাট সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংসদ মাঝেমধ্যে উদ্যোগ নেয়।’
দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহমুদা আক্তার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার অভাবে আমাদের বাড়ির পাশের কবি সম্পর্কে বলতে গেলে তেমন কিছুই জানি না। তাকে জানার জন্য গড়ে তোলা পাঠাগারটিও কোনোদিন খোলা পাইনি। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো একদিন তার চিহ্ন হারিয়ে যাবে। আগামী প্রজন্ম জানবেই না কাকিনায় এমন একজন কবি ছিলেন।’
বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির বাবু বলেন, ‘লালমনিরহাট জেলার গর্ব কবি শেখ ফজলল করিমের স্মৃতি রক্ষায় এখনই সরকারি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। পাঠাগারটি যেমন নতুন করে চালু করা দরকার, তেমনি প্রয়োজন একটি জাদুঘর তৈরি করা।’
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকিয়া সুলতানা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি নিজেও একজন বইপ্রেমী মানুষ। কালীগঞ্জে কিছুদিন আগে এসেছি। পাঠাগার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে কবির স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
সম্প্রতি কবির বাড়ির গেটের বিষয়ে একটি আবেদন পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেটি বরাদ্দের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, শেখ ফজলল করিম বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নাম। কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনায় ১৮৮৩ সালের ১৪ এপ্রিল জন্মেছিলেন এই কবি। ১৯৩৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মভিটায় মারা যান তিনি।
নীতিকাব্য, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবিক আদর্শ নিয়ে যিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন, পেয়েছেন ‘সাহিত্য বিশারদ’, ‘নীতি ভূষণ’ ও ‘কাব্যরত্নাকার’ উপাধি। অথচ এমন একজন মনীষীর স্মৃতি আজ অরক্ষিত।
সরকারি নজরদারি আর স্থানীয় উদ্যোগ না থাকলে ইতিহাসের পাতায় থাকা নামটি বাস্তব থেকে একদিন হারিয়ে যাবে—এ আশঙ্কাই করছেন সচেতন মহল।