পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর থানাধীন ডালবুগঞ্জ ও মহিপুর সদর ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা বরইতলা নদী আজ মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর। কাগজে-কলমে নাম ‘বরইতলা নদী’, তবে স্থানীয়রা এটি ‘সোনামুখী’ বা ‘গাববাড়িয়া নদী’ নামে চেনে। একসময় প্রাণবন্ত এই নদী এখন অপরিকল্পিত বাঁধের কারণে মৃতপ্রায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গাববাড়িয়া পয়েন্টে নির্মিত বাঁধের কারণে নদীর তিন শাখা কার্যত বন্ধ। বেড়িবাঁধের ভেতরে থাকা ১৯টি স্লুইসগেট অকেজো হওয়ায় জোয়ারের সময় পানি প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু ভাটায় বের হতে পারে না। ফলে বর্ষা মৌসুমে অন্তত ৪০টি গ্রাম জলাবদ্ধতায় ডুবে গেছে। প্রভাবিত কৃষিজমির পরিমাণ প্রায় ৭৫ হাজার একর। অর্ধলাখের বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
কৃষকরা অভিযোগ করেন, আগে খাল-বিলের পানি দিয়ে সহজে সেচ দেওয়া যেত, এখন ব্যয়বহুল যান্ত্রিক সেচের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে এবং জমি উর্বরতা হারাচ্ছে। বর্ষায় আমন জমি হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে গেলে বীজতলা তৈরি করতেও সমস্যায় পড়ছেন তারা। গবাদিপশু পালনও এখন বিপদে।
শুধু কৃষি নয়, নদীপথের নৌ-যোগাযোগ ও জীবিকা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। একসময় নদীপথে নৌকা, লঞ্চ ও ট্রলার চলাচল করত। ভাসানি ব্যবসায়ীরা নৌকায় পণ্য নিয়ে হাটে যেতেন। বর্তমানে শাখা খালগুলো পলিতে ভরাট হয়ে নদী ভূমিতে পরিণত হয়েছে, ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও মৎস্যজীবীদের জীবন বিপন্ন।
মনসাতলী গ্রামের কৃষক মো. সিদ্দিক বলেন, ‘স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদীর মুখে জাল পেতে কৃত্রিম জলাবদ্ধতা তৈরি করেছে। ফলে ধান বীজ ফেলতেও হিমশিম খাচ্ছি।’
মিরপুর গ্রামের কৃষক আলতাফ বলেন, ‘বরইতলা নদী আর নদী নেই, মরে গেছে। আগে জেলেরা মাছ ধরে বেঁচে থাকত, এখন এটি শুধু নামে নদী।’
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, বাঁধ নির্মাণের সময় হাজারো কৃষক প্রতিবাদ সমাবেশ করেছিলেন। একটি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছিল, তবে রহস্যজনকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিকল্পনাহীন বাঁধ নির্মাণই নদীর মৃত্যুর মূল কারণ।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)’-এর সমন্বয়ক মেজবাহউদ্দিন মাননু বলেন, ‘বাঁধ দিয়ে নদীর বুক ভরাট করা মানে নদী হত্যা। এতে শুধু নদী নয়, আশপাশের খাল, ম্যানগ্রোভ বনভূমি এবং জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়ছে।’
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. ইয়াসীন সাদেক জানান, বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে। কৃষক ও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লাঘবে টেকসই সমাধান নেওয়া হবে।