ময়মনসিংহ শহরের প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো একটি ঐতিহাসিক ভবন ভেঙে ফেলছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। বাড়িটি ছিল কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ, জমিদার হরিকিশোর রায়ের। এই ঘটনায় প্রত্নতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ ও সচেতন নাগরিকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র ক্ষোভ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে ব্যাপক সমালোচনা।
হরিকিশোর রায়ের নামেই শহরের একটি রাস্তার নাম ‘হরিকিশোর রায় রোড। জানা যায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী- সত্যজিৎ রায়ের দাদার- শিক্ষাজীবনের শুরুর অধ্যায় কেটেছে এই বাড়িতেই। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি হরিকিশোর রায়ের কাছে দত্তক হিসেবে আসেন এবং ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে বৃত্তি পেয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
ভবনটি ১৯৮৯ সাল থেকে শিশু একাডেমির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। তবে দীর্ঘদিন ধরে অযত্ন-অবহেলায় ভবনটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে এবং মাদকসেবীদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। শিশু একাডেমি কর্তৃপক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ভবনটি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা সাবিনা ইয়াসমিন জানান, ‘এটি রায় পরিবারের ঐতিহাসিক বসতভিটা। যদিও এখনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে তালিকাভুক্ত নয়, তবে চলতি বছরের জরিপে অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে।’
তিনি আরও জানান, ‘বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস মিলেছে।’
এই ঐতিহাসিক স্থাপনা ভাঙা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ‘ময়মনসিংহ সিটি’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে মুসরিন আক্তার মিম মন্তব্য করেন, ‘কেন ভাঙা হলো? প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন তো সংরক্ষণ করা উচিত।’ ফাল্গুনী চক্রবর্তী লেখেন, ‘শিশু একাডেমির ক্লাস করতাম এখানে।’
আশিকউজ্জামান নামে আরেকজন লেখেন, ‘পুরাতন ময়মনসিংহের অস্তিত্বই যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ শহরটিকে কলকাতার মতো রাজকীয়ভাবে গড়ে তোলা যেত।’
লেখক ও কবি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘২০০ বছরের পুরোনো ভবনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রক্ষা করে নতুন ভবন নির্মাণ সম্ভব ছিল। ইতিহাস-ঐতিহ্য ধ্বংস হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমরা কী রেখে যাচ্ছি?’
ময়মনসিংহ শিশু একাডেমির জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা মো. মেহেদী জামান জানান, ‘২০১০ সালের পর থেকে ভবনটি ব্যবহার উপযোগী ছিল না। তাই কার্যক্রম ভাড়াবাড়িতে চালানো হচ্ছিল, যাতে মাসে ৪৭ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছিল।’
তিনি আরও জানান, ‘ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের রিপোর্টের ভিত্তিতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই ভবনটি ভাঙা হচ্ছে। আপাতত একটি আধাপাকা ভবন এবং ভবিষ্যতে পাঁচতলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।’
ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রেজা মো. গোলাম মাসুম প্রধান বলেন, ‘শিশু একাডেমি কীভাবে এই ঐতিহাসিক ভবনটি ভেঙে ফেলছে, সে বিষয়ে জানতে তাদের ডাকা হয়েছে। কাগজপত্র যাচাই করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’