বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


কিশোরগঞ্জ (নীলফামারী) প্রতিনিধি

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২৪, ০২:৪২ পিএম

ছেলেকে জমি লিখে দেওয়ায় পর বৃদ্ধাশ্রমে বাবা-মা

কিশোরগঞ্জ (নীলফামারী) প্রতিনিধি

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২৪, ০২:৪২ পিএম

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দীর্ঘদিন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনে (বিএডিসি) কর্মরত ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব আনোয়ারুল মমিন। জীবনের আয়ের সবটুকু দিয়ে ছেলে-মেয়েদের পড়িয়েছেন সুনামধন্য স্কুল-কলেজে। তিন মেয়ের দুই মেয়েকে দিয়েছেন বিয়ে, ছেলেকে পাইয়ে দিয়েছেন চাকরি। সবকিছু মিলে সুন্দর জীবনযাপনের আশা করেছিলেন তিনি। তবে যে স্ত্রী-সন্তানকে সুখে রাখতে নিজের সর্বস্ব দিয়েছেন, তারাই যেন আজ তার আপন কেউ নয়।

আনোয়ারুল মমিনের বাড়ি রংপুরের পীরগাছার বড়দরগাহাট পূর্ব ফকিরা গ্রামে। সম্প্রতি তার ঠাঁই হয়েছে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের নিভৃতপল্লীতে গড়ে ওঠা নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে। শুধু আনোয়ারুলই নন, তার মতো অনেক অসহায় মা-বাবা বসবাস করছেন এই নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে। চোখে মুখে যাদের বয়সের ভাঁজ, অন্তহীন বেড়াজালে বন্দী তারা। এখন শুধু পরপারের হাতছানির অপেক্ষা। অথচ এই মা-বাবা একসময় তাদের সন্তানদের মানুষ করতে কতই না ছোটাছুটি করেছেন। তারাই আজ সন্তানের কাছে ঝরে পড়া শুকনো পাতার মতো।

সন্তানদের ঘরে জায়গা হয়নি এসব মা-বাবার। অভিমান হয় সন্তানদের প্রতি কিন্তু কোন ক্ষোভ নেই। বুকের মধ্যে হা হা কার, বোঝা নামাবার কোন জায়গা নাই। কখনো কষ্টের কথা মনে করে ডুকরে কাঁদেন, কখনওবা ভাবেন বেশ আছেন তারা।

সরেজমিনে নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে পঞ্চাশোর্ধ্ব আনোয়ারুল মমিন সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমার সামান্য একটু জমি ছিল, এক বছর আগে সেই জমিটা ছেলেকে লিখে দেই। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হলো এটাই যে আমি ছেলেকে ছেলেকে জমি লিখে দিয়েছি। ছেলেকে জমি লিখে দেওয়ায় মেয়ে কথা বলে না। আর ধীরে ধীরে ছেলেও কথা বলা ও আমাকে দেখাশুনা বন্ধ করে দেয়। এখানে আসার পর এখন পর্যন্ত আমার ছেলে-মেয়েরা কোনো খবর নেয় নাই। আর মনে হয় না কখনো তারা আমার খোঁজ নিতে আসবে। আর যদি তারা আসেও আমি যাব না। তারা আমাকে যে কষ্ট দিছে সেটা বর্ণনা করা সম্ভব না।

আনোয়ারুল মমিন বলেন, আমি বিএডিসিতে চাকরি করতাম। আমার এক ছেলে তিন মেয়ে। দুই মেয়ে আর ছেলের বিয়ে দিয়েছি, এক মেয়ের বিয়ে হওয়া এখন বাকি আছে। ছেলে-মেয়েদের নিজের সবটুকু দিয়ে লেখাপড়া করাইছি। আমার বাড়ি ছিল ১২ শতক জমিতে। বাড়িটা ছেলের নামে লিখে দেওয়ার পরে ছেলে আর কথা বলে না মেয়েরাও কথা বলে না। মেয়ে আছে দিনাজপুরে আমি কয়েকদিন আগে সেখানে গেছিলাম ৮ থেকে ১০ আমাকে কোনো খাবার দেয় না, আমার সাথে কেউ কথা বলে না আমার স্ত্রীও না। আমাকে ভাড়ার টাকাও দেয় নাই। শেষ পর্যন্ত আমি চলে আসছি সৈয়দপুরে বৃদ্ধাশ্রমে, কিন্তু ওখানে তারা শুধু মহিলাদের রাখেন। এরপর পর তারাই আমাকে সাজুর ভাইয়ের কথা বলেছিলেন। আমার চোখে উনি খুব ভালো লোক, আমাকে জুতা, জামা, কাপড়-চোপড় সবই দিয়েছেন। আমাকে এখান থেকে যাইতে দেন নি উনি। পরিবারের লোক কোনো খোঁজ খবর নেয় না, আমাকে বলছে যেখানে খুশি মন চায় চলে যাও।

তিনি আরও বলেন, দিনাজপুরে মেয়ের বাসায় যে কয়েকদিন ছিলাম আমি ঘুরে শুয়ে ছিলাম আর তারা ভাত খাইছে, আমাকে ভাত দেয় নাই। ছেলে যখন ঢাকা থাকে তখন ছেলের বউ বাড়িতে থাকতো, সকালে রান্না করতো না রান্না করতো তিনটার সময় ভাত দিতে দিতে পাঁচটা বাজতো। তখন ভাত খাইতাম এভাবে নামাজ রোজা হয় না। এভাবে পেটে ক্ষুধা নিয়ে কতদিন টিকতে পারা যায়। আমাকে তারা দীর্ঘদিন ধরে কষ্ট দিছে, ঠিকমত খাইতে দেয় নাই, অসুস্থ হলে ওষুধ পর্যন্ত কিনে দেয় নাই। আমি জীবনে যা আয় করছি ছেলে-মেয়েদের পিছনে ঢালছি। আমি জানি ছেলে-মেয়ে বড় হবে চাকরি করবে আমাকে দেখবে। কিন্তু তারা কেউই আমাকে দেখছে না।

ওই বৃদ্ধাশ্রমের আরেক বাসিন্দা আনোয়ারুল ইসলাম দুলাল। নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের ডিসেন্ট টেইলার্স নামক একটি প্রতিষ্ঠানে কাটিং মাস্টার হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন তিনি। টানাপোড়েনের সংসার হয়েও ছেলে-মেয়েদের পড়িয়েছেন সুনামধন্য স্কুল-কলেজে। স্ত্রীকে একটি স্কুলে পাইয়ে দিয়েছেন চাকরি। তবুও তার ঠাঁই হয়েছে নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এখানে অনেক ভালো আছি। সাজু ভাই নিজের ভাইয়ের মতো দেখে, সব দিক দিয়ে দেখাশুনা করে তিন বেলা ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করি। অসুস্থ হলে ঔষুধ কিনে দেয়। আমার পরিবারের কেউ খোঁজ নেয় না। তাদের কথা না বলাই ভালো।

রহিমা বেগম নামে বৃদ্ধাশ্রমের আরেক বাসিন্দা বলেন, আমার স্বামী মারা গেছে, একটা ছেলে ছিল মোটরসাইকেল এক্সিডেন্টে মারা গেছে। তারপর এখানে আসছি। এখানে কুব ভালো আছি।

বৃদ্ধশ্রমটিতে আশ্রিতদের দেখাশোনা করেন উপজেলার রণচণ্ডী এলাকার মনজিলা পারভীন। তিনি  বলেন, আমার বৃদ্ধ বাবা-মাদেরকে সেবা করতে খাওয়াইতে, কথা বলতে,  চলতে খুবেই ভালো লাগে। আমি মনে করি এই বৃদ্ধদের সেবাযত্ন করা মানে বাবা-মায়ের সেবাযত্ন করা। তারা ঠিকমতো খাইছে কি না, দুপুরে ঘুমানোর সময় ঠিকমতো ঘুমাইছে কি না, ঠিকমতো ওষুধ খাইছে কি না এসব আমি দেখাশোনা করি।

‍‍`ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/ মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার।’... নন্দিত কণ্ঠশিল্পী নচিকেতার এই গান শুনেই অনুপ্রাণিত হয়ে অসহায় বাবা-মার পাশে দাঁড়ানোর সংকল্প করেছিলেন বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সাজেদুর রহমান সাজু। স্বপ্ন বুননের সমাপ্তি ঘটিয়ে তা বাস্তবায়ন করেন ২০১৮ সালে। পেশায় ব্যবসায়ী সাজু কিশোরগঞ্জের বড়ভিটা ইউনিয়নের সামসুল হকের ছেলে।

কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স পাস করে নিজ গ্রামে কীটনাশকের ব্যবসা করে উপার্জিত টাকা দিয়ে নিজের জায়গায় কিশোরগঞ্জ সরকারি কলেজ-সংলগ্ন পাঁচটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করেন। স্বপ্নের বৃদ্ধাশ্রমটির নাম দেন ‍‍`নিরাপদ‍‍` বৃদ্ধাশ্রম।

প্রতিষ্ঠাতা সাজেদুর রহমান সাজু বলেন, আমার মুল উদ্দেশ্যই হচ্ছে অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মাকে তাদের নিজ সন্তানের কাছে ফেরত দেওয়া। আমি গত সপ্তাহ পর্যন্ত ২৮ জন বাবা মাকে তাদের সন্তানের কাছে ফেরত দিতে পেরেছি। এখানে সকল বাব-মায়ে থাকা খাওয়া কাপড় চিকিৎসা সবই ফ্রি। সবার সহযোগিতায় প্রতিষ্টানটি চলছে। আমি বৃদ্ধ বাবা-মাদের সেবার করার মাধ্যমে আনন্দ পাই।

তিনি আরও বলেন, নতুন করে গত সপ্তাহে দুইজন বাবা এখানে আসছে। একজন বাবা আব্দুল মান্নান উনি যখন স্টোক করেছিলেন তখন উনার পরিবারের সবাই ঢাকায় চলে গেছে। আরেকজন হলেন বিএডিসির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ারুল মমিন। উনি আসার পর ফেসবুকে পোস্ট করে তার পরিবারের খোঁজ করার চেষ্টা করছি। উনার সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। তারা যদি ভুল বুঝতে পেরে উনাকে এখান থেকে নিয়ে যায় আলহামদুলিল্লাহ।

আরবি/জেডআর

Link copied!