ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৫

‘সাদাপাথর লুটপাটে নিয়ন্ত্রণ চালায় রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরা’

আব্দুল আহাদ, সিলেট
প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০২৫, ১১:৫১ এএম
ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকায় চলছে দিনরাত অবাধে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব। ছবি- সংগৃহীত

সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকায় চলছে দিনরাত অবাধে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব। এক সময় পর্যটনে সমৃদ্ধ এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এলাকা এখন রূপ নিয়েছে অবৈধ সিন্ডিকেটের দখলে। স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে একটি সুসংগঠিত চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট, আর প্রশাসন রয়েছে নিরব দর্শকের ভূমিকায়।

স্বচ্ছ নদীজল, পাহাড়ি ঢল আর চোখ জুড়ানো সাদাপাথরের সৌন্দর্যে ঘেরা ভোলাগঞ্জ এক সময় ছিল সিলেটের গর্ব। পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকত এলাকা। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। নদীর বুক চিরে শুরু হয় পাথর লুটের উৎসব। চলছে শত শত নৌকা, ড্রেজার ও সাইলেন্ট মেশিন দিয়ে দিনরাত পাথর উত্তোলন।

স্থানীয়দের ভাষায়, ‘এখন এখানে শুধু লুটেরাদের শাসন।’

৬০ বছর বয়সী বাসিন্দা রহমত আলী বলেন,  ‘পাথরের নিচে নদী হারিয়ে যাচ্ছে। যেখানে পানি ছিল, এখন কেবল গর্ত আর ধুলা।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাথর উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ করছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। নেতৃত্বে রয়েছেন স্থানীয় পর্যায়ের একাধিক রাজনৈতিক নেতা, বিশেষ করে যুব ও ইউনিয়ন পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রতিটি নৌকা থেকে আদায় করা হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা ‘চাঁদা’। এই চাঁদার অর্থ ভাগ হয়ে যায় রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের পকেটে।

এক জনপ্রতিনিধি অনিচ্ছুক অবস্থায় জানান, ‘যার যার সেক্টর ভাগ করে দেওয়া আছে। কত চাঁদা দিতে হবে, কে কোথা থেকে তুলবে- সব নির্ধারিত। রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরাই মূল নিয়ন্ত্রক।’

সরকারি টাস্কফোর্স মাঝে মধ্যে অভিযান চালালেও তা অকার্যকর বলেই মনে করছেন স্থানীয়রা। অভিযানের আগে খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সিন্ডিকেট সদস্যরা আগেই এলাকা ছাড়ে। অভিযান শেষে ফের শুরু হয় আগের চিত্র।

উপজেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানান, ‘চেষ্টা করছি, কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীদের বাধায় কার্যকর পদক্ষেপ সম্ভব হচ্ছে না।’ জনবল ও যন্ত্রপাতির অভাবকেও কারণ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার বলেন, ‘নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেও পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখা যাচ্ছে না। আমরা এলাকা ছাড়লেই আবার শুরু হয়।’

সাদা পাথরের পরিবেশ আজ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে। নদীর স্বচ্ছ পানি আজ ঘোলা, পাথরের স্তূপে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খল গর্ত। এক সময়ের পর্যটনকেন্দ্র এখন পরিণত হয়েছে কেবলমাত্র পাথর ব্যবসায়ীদের দখলে থাকা এক জনপদে। মেশিনের শব্দ, ট্রাকের ধুলো, শ্রমিকের ভিড়ে পর্যটনের অস্তিত্ব আজ বিলীন।

পরিবেশবিদ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম বলেন, ‘এই গতিতে চলতে থাকলে আগামী এক বছরের মধ্যে সাদাপাথরের অস্তিত্বই থাকবে না। এটা শুধু পর্যটনের ক্ষতি নয়, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিগত ১৫ বছরে যত পাথর লুট হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে গত এক বছরে। সবাই এখন লুটপাটে যুক্ত- রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের কেউ, স্থানীয় প্রভাবশালী- কেউ বাদ নেই।’

কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের মাহমুদ আদনান বলেন, ‘অবৈধ পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযান চালানো হয়েছে। কয়েকটি নৌকা ও যন্ত্রপাতি জব্দ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তবে স্থানীয়রা বলছেন, এসব বক্তব্য বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। তারা মনে করেন, পুলিশ বা প্রশাসনের একার পক্ষে নয়, বরং রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এই সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয়।