ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

টিকটকে ভয়াবহ আসক্তি; বিপথে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা

মিসবাহ উদ্দিন, বিয়ানীবাজার
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৪, ২০২৫, ০২:৫০ পিএম
বিয়ানীবাজারে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের টিকটকে ভয়াবহ আসক্তি। ছবি- প্রতীকী

প্রযুক্তির হাত ধরে বাংলাদেশে দ্রুতগতিতে বেড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে টিকটক, ফেসবুক রিলস ও ইনস্টাগ্রাম ভিডিও তৈরির প্রবণতা এক অদ্ভুত মাত্রা নিয়েছে। তবে এই 'বিনোদন' অনেক ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে আসক্তিতে—যা এখন উদ্বেগজনক হারে ছড়িয়ে পড়েছে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায়।

বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষক, অভিভাবক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিন দিন বিয়ানীবাজারে শিক্ষার্থীদের মধ্যে টিকটক ও রিলস ভিডিও তৈরির প্রতি অস্বাভাবিক আসক্তি গড়ে উঠছে। এতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ছে, ক্লাস ফাঁকি দিচ্ছে, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত নিয়মকানুনও লঙ্ঘন করছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, শুধু টিকটক বা রিলস বানানোই নয়, এর পেছনে সময়, পরিকল্পনা, পোশাক, মেকআপ—সব কিছুতে শিক্ষার্থীরা এতটাই মগ্ন হয়ে পড়ে যে তারা ক্লাস, পরীক্ষা, এমনকি প্র্যাকটিক্যাল পর্যন্ত মিস করছে।

তিনি জানান, শিক্ষকরা বারবার সতর্ক করলেও শিক্ষার্থীরা বিকল্প রাস্তা খুঁজে নেয়। স্কুলে মোবাইল আনা নিষেধ থাকলেও অনেকেই গোপনে ফোন নিয়ে আসে, ক্লাস চলাকালীন সুযোগ পেলেই বাথরুম বা মাঠে গিয়ে ভিডিও করে। শুধু শিক্ষা ব্যাঘাতই নয়, এই ভিডিও আসক্তির কারণে অনেক শিক্ষার্থী প্রেমের সম্পর্ক, প্রেমঘটিত দ্বন্দ্ব এবং এমনকি শারীরিক সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ছে।

সমাজকর্মী ও বিয়ানীবাজার প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মিলাদ জয়নুল ইসলাম বলেন, এমন অনেক ঘটনাই আছে যা প্রকাশ্যে আসে না। অভিভাবকের মান-সম্মান রক্ষায় বা বিদ্যালয়ের সুনাম রক্ষার কারণে অনেক সময় ঘটনাগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়, আমাদের এলাকার তরুণ-তরুণীরা প্রযুক্তির অপব্যবহার করে অশ্লীলতায় নিমজ্জিত না হয় তার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সজাগ দৃষ্টি দিবেন। সচেতন অভিবাবকরা অশ্লীলতার তত্ত্ব দিয়ে বিয়ানীবাজার থানা পুলিশকে সহযোগিতা করবেন।

সচেতন মহলের প্রশ্ন- তরুণ-তরুণীদের উচ্চভিলাষী চলাচলের বিশাল এই টাকার উৎস কোথায়। তরুণীরা কি তাহলে বিলাশবহুল চলাচলের জন্য অনৈতিক কোনো কাজে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছেন।

ঢাকা দায়রা জজ আদালতের বিশিষ্ট আইনজীবী এডভোকেট এইচ এম শাওওনুর রহমান উজ্জ্বল বলেন, বর্তমানে আমাদের স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশ টিকটক ও রিলস ভিডিও তৈরির প্রতি অতিমাত্রায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। এটি শুধু তাদের পড়াশোনার ক্ষতিই করছে না, পাশাপাশি সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনেক সময় এসব প্ল্যাটফর্মে ভাইরাল হবার আকাঙ্ক্ষা থেকে শিক্ষার্থীরা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অশোভন কনটেন্ট তৈরি করছে, যা ভবিষ্যতে তাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

তিনি আরও বলেন, অভিভাবকদের উচিত ঘরে সন্তানদের সময় দেওয়া, তাদের ডিজিটাল-প্লাটফর্ম ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করা এবং স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষের উচিত শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা তৈরির জন্য কর্মশালা ও কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে সরকারিভাবে টিকটক ও রিলসের মতো অ্যাপে বয়স ও সময় নির্ভর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে—এই শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।

স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে টিকটক ও রিলস ভিডিওর আসক্তি নিয়ে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক লেখক মাহফুজা খানম বলেন, বর্তমান প্রজন্ম প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার দিকেও প্রবলভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে টিকটক ও রিলসের মতো ছোট ভিডিও প্ল্যাটফর্মগুলো তরুণদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তবে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই আসক্তি এখন পড়াশোনা, মনোসংযোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে। অনেক শিক্ষার্থী দিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এসব ভিডিও দেখায় ব্যয় করছে, যা তাদের একাডেমিক পারফরম্যান্স ও সামাজিক দক্ষতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের উচিত শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সমন্বয়ে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া। শিক্ষার্থীদের সময় ব্যবস্থাপনা, গঠনমূলক বিনোদন এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে ভারসাম্য রক্ষায় দিকনির্দেশনা দিতে হবে। শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, তাদের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতার বিকাশ ঘটানো জরুরি।

সিলেট জেলা দায়রা আদালতের শিক্ষানবিশ আইনজীবী আক্তার হোসেন লিমন বলেন, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শিক্ষার পরিপূরক হতে পারে। কিন্তু অপব্যবহার তরুণ প্রজন্মকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের সময় ব্যবস্থাপনা শেখানো ও মনোযোগ ফেরানোর কাজ পরিবার ও শিক্ষকদের সম্মিলিত দায়িত্ব।

বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এর প্রভাষক বিজিত আচার্য্য বলেন, বর্তমানে শিক্ষার্থীরা টিকটিক ও রিলস ভিডিও এর প্রতি যে সময় ব্যয় করে তা যদি বই পড়ার প্রতি বা ই-বুক পড়ে সময় ব্যয় করতো তাহলে নিজেদের জ্ঞান বৃদ্ধি করে পরিক্ষায় ভালো ফলাফল করতে পারত। কিন্তু টিকটক ও রিলস ভিডিও ধারণ করে মানসিক বিকার গ্রস্থ হচ্ছে, শারীরিকভাবে পরিবার ও সমাজে অশান্তি নিয়ে আসছে। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অশনিসংকেত।

বিয়ানীবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে টিকটক ও রিলস আসক্তি যে শুধু তাদের পড়াশোনা নয়, সামাজিক, নৈতিক ও পারিবারিক বন্ধনেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে, তা এখন স্পষ্ট। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজ এবং সরকার—সবার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন সচেতন মহল।