ঢাকা বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ

মনিরুজ্জামান মনির, টাঙ্গাইল
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১০, ২০২৫, ১২:৩১ এএম
বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রচারণার কাজে ব্যবহার করা হয় মাইক। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

টাঙ্গাইল জেলা শহরে বিভিন্নভাবে শব্দদূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে, সভা-সমাবেশ ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রচারণার কাজে ব্যবহার করা মাইকের উচ্চমাত্রার শব্দে ব্যহত হচ্ছে স্বাভাবিক পরিবেশ। শব্দ দূষণ প্রতিরোধে নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ।

টাঙ্গাইল শহরের শহিদ স্মৃতি পৌর উদ্যান ও কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে মাঝে মাঝেই অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ব্যবহার করা হয় উচ্চ মাত্রার শব্দযন্ত্র। অথচ কাছেই রয়েছে নজরুল সেনা স্কুল, বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, জামে মসজিদ, টাঙ্গাইল প্রি-ক্যাডেট স্কুল এবং টাঙ্গাইল সরকারি মহিলা কলেজ। সভা-সমাবেশের সময় শহীদ স্মৃতি পৌর উদ্যানের পাশে জেলা সদর সড়কের পৌরসভার ল্যাম্পপোস্ট ও বিদ্যুতের খুঁটিতে কয়েকটি করে মাইক লাগানো হয়ে থাকে। এসব মাইকের শব্দ পৌঁছে যায় অনেক দুরবর্তী। যদিও নামাজ চলাকালিন সময় অল্প সময়ের জন্য শব্দ বন্ধ রাখা হয়, কিন্তু এরপর যে পরিমাণে শব্দযন্ত্র ব্যবহার করা হয় সেগুলোর তীব্র শব্দে স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যহত হয়।

এ ছাড়াও টাঙ্গাইল শহরে বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়, টাঙ্গাইল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, টাউন প্রাইমারি স্কুল, মডেল প্রাইমারি স্কুল, বিবেকানন্দ স্কুল এন্ড কলেজ, পুলিশ লাইনস উচ্চ বিদ্যালয়, কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজ, কুমুদিনী কলেজসহ বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে।

বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং সভা সমাবেশের প্রচারণার কাজে ব্যবহৃত মাইক শহরের বিভিন্ন সড়কে ঘুরে ঘুরে তাদের প্রচারণা চালায়, সড়কগুলো অধিকাংশই কোনো না কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল/ক্লিনিক সংলগ্ন।

প্রচারণার কাজ করা ব্যক্তিদের অসচেতনতা এবং প্রচার মাইকের নীতিমালা অনুসরণ না করার কারনে মাইকের অতিমাত্রার শব্দে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। নির্বাচনকালীন সময়ে প্রচার মাইকের নিয়ম মানা হলেও বাকি সময়ে কোনো প্রকার নিয়ম মানছেন না প্রচার মাইকের কাজ করা ব্যক্তিরা ।

আবার, কিছু কিছু বকাটের মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের সাইলেন্সারে হলার নামক অংশ এবং হাইড্রলিক হর্ণ  লাগিয়ে থাকে। এসব যানবাহন রাস্তায় চলার সময় বিকট শব্দের সৃষ্টি হয়, যেই শব্দ আশেপাশের পথচারীদের চরম বিরক্তির কারন। তবে এসব বিকট শব্দের যানবাহনের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে জেলা পুলিশ পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়।

আবার বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠান উপলক্ষেও বিভিন্ন বাসা বাড়িতে অনুষ্ঠানের আগে থেকে শুরু করে পর পর্যন্ত উচ্চ মাত্রার শব্দযন্ত্র বাজিয়ে এবং বাজি ফুটানোর মাধ্যমে আনন্দ করেন, এতে করে আশেপাশের প্রতিবেশীরা চরম বিরক্তিকর একটা পরিবেশের মধ্যে পরে যায়।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অনুসারে ডেসিবেল সীমা আবাসিক এলাকায় দিনের বেলায় ৫৫ dB এবং রাতে ৪৫ dB-এর বেশি শব্দ করা যাবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় এই সীমা যথাক্রমে ৬০ dB ও ৭০ dB।

নীরব এলাকায় হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিসের ১০০ মিটারের মধ্যে নীরব এলাকা হিসেবে গণ্য হবে, যেখানে শব্দ দূষণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। পরিবেশ অধিদপ্তর ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা আইন প্রয়োগ করার কথা উল্লেখ থাকলেও সে বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না।

জেলার সচেতন নাগরিকরা মনে করেন সভা-সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রচার প্রচারণাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শব্দযন্ত্র ব্যবহারের সঠিক নীতিমালা থাকা প্রয়োজন এবং নীতিমালা অনুসরণ করার ব্যপারে প্রশাসনের জোড়ালো পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।

বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তরুণ ইউসুফ বলেন, প্রায়শই রাস্তায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশের প্রচার মাইক লক্ষ্য করা যায়, দেখা যায় একসাথে চার-পাঁচটা অটোতে দুইটা করে হর্ণ লাগিয়ে প্রচারণা চালায়। এর ফলে অসহনীয় শব্দ দূষণ হয়। যে এলাকা দিয়ে এই প্রচার মাইকগুলো চলাচল করে সেসব এলাকায় মানুষজন খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে।  এই শব্দদূষণ প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জোড়ালো পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ।

পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠন সেফ লাইফ এর সভাপতি মো. রুবেল মিয়া বলেন, টাঙ্গাইল শহরটা খুব বেশি বড় না, এই শহরে অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। প্রচারণার কাজে ব্যবহৃত মাইকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস চলাকালীন সময়েও আশে পাশে ঘুরাঘুরি করে যার ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মাইকম্যান বলেন, যারা প্রচারণা করায় তারা আমাদেরকে মাইকসহ ঘণ্টা চুক্তিতে ভাড়া করেন। টাঙ্গাইল শহরের প্রায় সব এলাকায়ই দু-একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। থেমে থেমে প্রচারণা করলে যারা প্রচারণা করায় তারা মনঃক্ষুণ্ন হয়। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন সাউন্ড সিস্টেম ব্যবসায়ী বলেন, বিভিন্ন সভা-সমাবেশ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যারা সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া নেয় তাদের উচিৎ পরিবেশ আইন মেনে শব্দ যন্ত্র ব্যবহার করা। কিন্তু তারা তো তাদের নিজেদের মতো করে শব্দ যন্ত্র ব্যবহার করে। অনেক সময় আমাদের নির্দেশনাও শোনে না।

পরিবেশ অধিদপ্তর টাঙ্গাইলের উপপরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, যেসব যানবাহনে হাইড্রলিক হর্ণ লাগানো থাকে অভিযান পরিচালিত করে সেসব যানবাহন থেকে হাইড্রলিক হর্ণ খুলে নেয়া হয় এবং জরিমানা করা হয়।

সাম্প্রতিক একটা প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে, পরবর্তীতে সে অনুসারে আরও পদক্ষেপ নেয়া হবে।