আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন জালিয়াতি, দুর্নীতি ও লুটপাট সংঘটিত হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব লুটপাটের মাধ্যমে প্রচলিত নিয়ম ভেঙে বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, যেগুলোর বড় অংশই বর্তমানে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, যা পুরো আর্থিক খাতকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ী, আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের নেতৃত্বে অন্তত ১১টি ব্যাংক দখল করে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। এর মধ্যে বড় অংশই এখন খেলাপি। জালিয়াতি করা এই অর্থের একটি অংশ বিদেশে পাচার করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আলোচিত গ্রুপগুলোর মধ্যে রয়েছে হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, এন্যান টেক্স, ক্রিসেন্ট, বিসমিল্লাহ, এস আলম, বেক্সিমকো, সিকদার, ওরিয়ন, নাসা ও নাবিল গ্রুপ।
বিশেষভাবে আলোচিত এস আলম গ্রুপ প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছে, যার মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। বর্তমানে এ গ্রুপের খেলাপি ঋণ ৪০ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে, বেক্সিমকো গ্রুপের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা, আর সিকদার গ্রুপের খেলাপি ঋণ ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
ব্যাংক খাতের এই অস্থিরতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ গ্রাহকরা। বর্তমানে এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ভয়াবহ তারল্য সংকটে পড়েছে।
এসব ব্যাংকে আমানতকারী হাজার হাজার মানুষ এখন তাদের কষ্টার্জিত অর্থ ফেরত না পেয়ে চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে ধারদেনা করে সংসার চালাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ ব্যাংকে গিয়ে কান্নাকাটি করে ফিরে আসছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, এসব পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা এবং বিতরণকৃত ঋণ ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকাই খেলাপি, যা বিতরণ করা ঋণের ৭৭ শতাংশ। মূলধনে ঘাটতি ৪৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা ৯২ লাখ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি।
২০২০ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে। ২০২০ সালের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৬ হাজার ১২০ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালের জুনে বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এরপর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে ৩ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
সর্বশেষ, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে প্রভিশন ঘাটতিও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকায়, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে ব্যাংক খাত সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে, ৫২ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দেওয়া হয় এবং একীভূতকরণের মাধ্যমে খাতকে স্থিতিশীল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, যেসব ব্যাংক আর্থিক সূচকে উন্নতি করতে ব্যর্থ হবে, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত করা হবে।
ব্যাংক খাত বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ধারাবাহিক লুটপাট ও রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া ঋণের কারণে।
আইএমএফ-এর মতে, ব্যাংক খাত পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজন ৩৫ বিলিয়ন ডলার। সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘ব্যাংক খাতের ৮০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়েছে।’
এরই মধ্যে বহু গ্রাহক এখনো টাকা ফেরত না পেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। ফার্স্ট সিকিউরিটি, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিদিনই গ্রাহকরা তাদের সঞ্চয় ফেরত না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। অনেকে দিনের পর দিন ব্যাংকের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও টাকা পাচ্ছেন না।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার একীভূতকরণ, দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা ও কঠোর তদারকির মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনতে আরও স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দ্রুততম সময়ে কার্যকর ব্যবস্থা প্রয়োজন।