নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের মেঘনা ঘাটে অবস্থিত আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেড তুরস্কে সাড়ে পাঁচ হাজার ডেডওয়েট টনের (ডিডব্লিউটি) অত্যাধুনিক বহুমুখী জাহাজ ‘ওয়েস ওয়্যার’ রপ্তানি করতে যাচ্ছে।
আগামী রোববার (০৭ সেপ্টেম্বর) জাহাজটি আনুষ্ঠানিকভাবে তুরস্কের বিখ্যাত কোম্পানি নোপ্যাক শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং লিমিটেডের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
হস্তান্তর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। এ সময় শিল্প মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং বাংলাদেশে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত রমিজ সেন উপস্থিত থাকবেন।
বাংলাদেশের ‘সবচেয়ে বড়’ জাহাজ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আনন্দ শিপইয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, উন্নত নকশা ও আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘ওয়েস ওয়্যার’। জাহাজটির দৈর্ঘ্য ৩৪১ ফুট, প্রস্থ ৫৫ ফুট এবং গভীরতা ২৫ ফুট। এটি একটি ২ হাজার ৭৩৫ হর্স পাওয়ার বা অশ্বশক্তি ইঞ্জিন দ্বারা চালিত। এটি প্রতি ঘন্টায় ১২ নট গতিতে ৫ হাজার ৫০০ টন পণ্য বহন করতে সক্ষম। জাহাজটি ইস্পাতের কয়েল, কয়লা, সার, খাদ্যশস্য এবং রাসায়নিক পদার্থ সহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য সামগ্রী পরিবহনের জন্য উপযুক্ত।
এর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে কোম্পানিটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক এনজিয়ান শিপিং কোম্পানি লিমিটেডে ৬ হাজার ১০০ ডিডব্লিউটি জাহাজ রপ্তানি করে, যা সে সময় বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা সবচেয়ে বড় জাহাজগুলোর মধ্যে একটি ছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে জাহাজ তৈরি শিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরে তা রপ্তানি করে বছরে ২ বিলিয়ন ডলার আয়ের পথ তৈরি সম্ভব। এ ছাড়াও, গভীর সমুদ্রে রাসায়নিক কারখানা স্থাপন করে জলজ উদ্ভিদ ও সামুদ্রিক শৈবাল থেকে ঔষধ কারখানার জন্য কাঁচামাল সরবরাহ সম্ভব। ফলে, দেশের ঔষধ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমবে ও বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
আনন্দ শিপইয়ার্ডের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। আজ অবধি, তারা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় ক্লায়েন্টদের কাছে ৩৫০ টিরও বেশি জাহাজ সরবরাহ করেছে। ২০০৮ সালে আনন্দ শিপইয়ার্ড ডেনমার্কে কন্টেইনার জাহাজ 'স্টেলা মেরিস' রপ্তানির মাধ্যমে সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানিকারক হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। তারপর থেকে জার্মানি, নরওয়ে, মোজাম্বিক, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশে রপ্তানি করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির কারিগরি পরিচালক ড. নাজমা নওরোজ জানান, জাহাজটির নির্মাণ কাজ শেষে সকল মেশিনারি টেস্ট ট্রায়াল কাজ সম্পন্ন। সি ট্রায়াল শেষ হওয়ায় জাহাজটিকে ক্রেতার নিকট বুঝিয়ে দিতেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, জাহাজ নির্মাণ শিল্পখাতকে বিভিন্ন সুবিদাধি দেয়া শুধুমাত্র সময়ের দাবি নয় বরং একাধিক রপ্তানি খাতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, জাহাজ নির্মাণ শিল্প ব্লু-ইকোনমির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং এর উন্নয়ন ছাড়া ব্লু-ইকোনমি সঠিকভাবে বিকশিত হওয়া সম্ভব নয়।
৯ লাখ বর্গফুট আয়তনের আনন্দ শিপইয়ার্ডে ড্রেজার ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত জাহাজের পাশাপাশি একসঙ্গে ১০ হাজার টন পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের ৮টি জাহাজ নির্মাণের সক্ষমতা রয়েছে। সার্বক্ষণিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শিপইয়ার্ড বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহেল বারী বলেন, ২০২২ সালের পর আমরা জাহাজ রপ্তানি শুরু করেছি। এখন তুরস্কে যাওয়া জাহাজটি এ পর্যন্ত পাঠানো জাহাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং প্রযুক্তিগতভাবে সবচেয়ে উন্নত জাহাজ।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, একটি জাহাজের অর্থায়নের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে। তবে বাকি ১৫ শতাংশ ২৫-৩০ কোটি টাকার সমপরিমাণ (২.৫-৩ মিলিয়ন ডলার) - আমাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যবস্থা করতে হবে। এত বড় পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা কঠিন কারণ ব্যাংকগুলি প্রায়শই এটি সরবরাহ করতে অনিচ্ছুক থাকে। ফলে উৎপাদনের সময় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল আটকে থাকে, যার ফলে বিলম্ব হয়।
তিনি আরও বলেন, দেশের জাহাজ নির্মাণ খাতের অপার সম্ভাবনা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্প সুদে অর্থায়নের অভাব এ শিল্পকে কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ
বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ খাতকে সম্ভাবনাময় মনে করে ২০০৮ সালে ডেনমার্কে অত্যাধুনিক কন্টেইনার জাহাজ ‘স্টেলা মেরিস’ রপ্তানি করে আনন্দ শিপইয়ার্ড। তাদের এই রপ্তানির কারণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদীয়মান জাহাজ নির্মাণ জাতি হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। গত দেড় দশকে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ধরনের ৩৫৬টিরও বেশি জাহাজ তৈরি করেছে। দক্ষ জনশক্তি, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক মান মেনে চলা এ খাতের প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে। এর মধ্যে আছে কার্গো জাহাজ, যাত্রীবাহী জাহাজ, মাল্টিপারপাস আইস-ক্লাস ভেসেল, ল্যান্ডিং ক্রাফ্ট, অফশোর প্যাট্রল ভেসেল, টাগবোট, মাছ ধরার জাহাজ, বাল্ক ক্যারিয়ার ও কনটেইনার ক্যারিয়ার।
ইতিমধ্যে দেশে থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ডেনমার্ক, জার্মান, নরওয়ে, মোজাম্বিক ও ইউকেসহ বিভিন্ন দেশে ৫০টি জাহাজ রপ্তানি করেছে।
বর্তমানে, দেশে ৩০টিরও বেশি বড় শিপইয়ার্ড রয়েছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি সরাসরি আন্তর্জাতিক বাজারে জাহাজ রফতানি করে। এশিয়ার জাহাজ নির্মাণ শিল্পে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের পর বাংলাদেশ ধীরে ধীরে তার উপস্থিতি অনুভব করছে। মাঝারি আকারের পণ্যবাহী জাহাজ, কন্টেইনার জাহাজ, ট্যাংকার ও ড্রেজার নির্মাণে দেশটি ক্রমবর্ধমান সুনাম অর্জন করছে।
যদিও প্রাথমিক ফোকাস অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের দিকে রয়ে গেছে, গত দশকে রফতানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ জ্বালানি, ৭০ শতাংশ কার্গো এবং ৩৫ শতাংশ যাত্রী পরিবহন নৌপথে সম্পন্ন হয়। এই বিশাল চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন আকারের প্রায় ৩০০ শিপইয়ার্ড স্থাপন করা হলেও এর মধ্যে মাত্র ১০টিতে প্রায় তিন লাখ শ্রমিক নিয়োজিত রেখে রফতানি মানের জাহাজ নির্মাণ করা যায়।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মতে, বর্তমানে দেশে শতাধিক জাহাজ নির্মাণ কোম্পানি এবং ১২০টিরও বেশি নিবন্ধিত শিপইয়ার্ড রয়েছে এবং উদ্যোক্তাদের অনুমান প্রায় ৩০০টি সক্রিয় শিপইয়ার্ড রয়েছে।
দেশীয় জাহাজের বাজার বার্ষিক ১০-১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে, যেখানে রপ্তানি প্রতি বছর ৫-৬ শতংশের তুলনামূলকভাবে ধীর গতিতে বাড়ছে। দেশের স্থানীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বার্ষিক মূল্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।
বর্তমান সক্ষমতা দিয়ে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ২০টি জাহাজ রপ্তানি করতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে, আঞ্চলিক পরিষেবার জন্য বহুমুখী জাহাজ, কার্গো ফিডার এবং যাত্রীবাহী ফেরির মতো ১২,০০০ ডিডব্লিউটি পর্যন্ত ছোট জাহাজের সেগমেন্টে দেশের শক্তিশালী সম্ভাবনা রয়েছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন