ঢাকা শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫

ঢাবি ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যা

কিলিং মিশনের ৯ সদস্য অধরা

মেহেদী হাসান খাজা
প্রকাশিত: মে ১৬, ২০২৫, ০৪:৫৬ এএম
নিহত ঢাবি শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য। ছবি- সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য খুনের ঘটনায় তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ঘটনায় যে তিনজন আসামিকে ধরা হয়েছে তারা সবাই মাদক সেবনের উদ্দেশ্যে সোহরাওয়ার্দীতে আসছিল। তারা সাম্যকে হত্যার আগে তার মোটরসাইকেল ফেলে দেয়, সেই কারণ জানতে চাইলে শুরু হয় সংঘর্ষ।

সংঘর্ষের একপর্যায়ে সাম্যকে হত্যার কিলিং মিশনে অংশ নেয় ১২ জন। এ ঘটনায় আপাতত ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও বাকি ৯ জন ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে, তবে তাদের খোঁজা হচ্ছে। পুলিশের ভাষ্যমতে, তুচ্ছ ঘটনার জেরে সাম্যকে হত্যা করা হয়। আসামিরা সবাই পেশায় ভাসমান হকার ও নেশাগ্রস্ত। তবে গোয়েন্দারা বলছেন, সাম্য হত্যার মূল কারণ ঘিরে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। যেটা বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

এদিকে এ ঘটনার জেরে টিএসসিসংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশের এলাকায় ভাসমান সব দোকান উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে সিটি করপোরেশন। গতকাল বৃহস্পতিবার এ অভিযান শুরু হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মনসুর। অন্যদিকে সাম্য হত্যার বিচার দাবিতে রাজপথে সক্রিয় ছাত্রদল। সংগঠনটি ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। এ ছাড়া  ঢাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে, প্রতিশোধ নিয়েই ঘরে ফেরার শপথ নিয়েছে ছাত্রদল। তবে সংগঠনটির দাবি, সাম্য হত্যার ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করতে হবে।

অবশ্য ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যার পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, অবিলম্বে সাম্য হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে হবে। শাহবাগে জাতীয় সংগীত বন্ধের আন্দোলনের বিরুদ্ধে সাম্য একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটাই কী তাকে হত্যার কারণ? বিগত ১৬ বছর ছাত্রলীগের নিপীড়ন-নির্যাতন দেখেছি। এখন তো তারা নেই। তাহলে এখনো কেন ক্যাম্পাসে ছাত্রদের রক্ত ঝরছে?  রিজভী বলেন, পুলিশকে গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টিকে খতিয়ে দেখতে হবে। 

এদিকে সাম্যকে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত তামিম হাওলাদারের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। গত বুধবার সন্ধ্যায় স্থানীয় একদল জনতা তামিমের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আলোচিত এ হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তারকৃত তিনজনের বাড়িই মাদারীপুরে। মাদারীপুর সদর মডেল থানার ওসি আদিলুর রহমান এসব তথ্য জানান।

এ ঘটনায় ডিএমপি জানিয়েছে, থানা-পুলিশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে হত্যায় জড়িত অন্য ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ, তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত তথ্য প্রমাণ নিয়ে কাজ করছে। এই হত্যার কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া বাকি ৯ জনকে আইনের আওতায় আনতে পুলিশ তৎপর। 

বিচার দাবিতে বিক্ষোভ, ঢাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ

সাম্য হত্যার প্রতিবাদ ও বিচার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা হচ্ছে না। প্রশাসনের আধা বেলা শোক প্রত্যাখ্যান করে পূর্ণ দিবস ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও ধর্মঘট পালন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। এ হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে ছাত্রদলও। গতকাল বৃহস্পতিবার ‘সন্ত্রাসবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ঢাবির ভিসি ভবনের আশপাশে ও বিভিন্ন জায়গায় এই কর্মসূচি পালন করে। তবে ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যার প্রতিশোধ নিয়েই ঘরে ফেরার শপথ গ্রহণ করেছে ছাত্রদল।

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আমানুল্লাহ আমান জানান, আমাদের সহযোদ্ধা নিরপরাধ সাম্যকে যারা হত্যা করেছে অনতিবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এর আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সুরক্ষিত জায়গায় তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ড হয়েছে। আমরা চাই না নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কেউ হত্যাকাণ্ডের শিকার হোক। এই হত্যার স্পষ্ট দায় নিয়ে অথর্ব ভিসির পদত্যাগ আমরা দাবি করছি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছি।

তিনি আরও বলেন, যারা সত্যিকার অর্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধারণ করে এবং যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি রয়েছে তাদের মধ্যে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ দেওয়া হোক। সাম্য হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত ছাত্রদল রাজপথে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছে।

এ বিষয়ে সাম্যের চাচা হাজি কায়সারুল আলম কায়েস জানান, গত শুক্রবার ঢাকায় আমার বড় ভাতিজির গায়েহলুদ অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে সাম্যের সঙ্গে কথা হয়। জানতাম না, এটাই হবে তার সঙ্গে আমার শেষ কথা। সাম্যের কী অপরাধ ছিল যে, মা হারা ছেলেটিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। এমন মেধাবী ভাতিজার মৃত্যু মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ফাঁসি চাই।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোটরসাইকেলের সঙ্গে ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা পলাশ ছুরি দিয়ে আঘাত করতে থাকে সাম্যকে। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় তার। পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা পেশায় হকার হলেও রাতে ছিনতাইসহ নানা অপরাধে লিপ্ত তারা। তবে এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে পূর্ববিরোধ বা অন্য কোনো কারণ আছে কি না, সম্ভাব্য সব কারণ মাথায় রেখে তদন্ত করছে পুলিশ।  

কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় এই হামলার ঘটনাটি ঘটল, ঘটনাস্থলে থাকা তার সহপাঠী, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা হলে তার একাধিক সহপাঠীরা জানান, রাতে মোটরসাইকেল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর যাচ্ছিলেন সাম্য। এ সময় অন্য একটি মোটরসাইকেলের সঙ্গে তার মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগলে উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়। সাম্যর সহপাঠী শাহেদ হোসেন বলেন, আমাদের একটা নবীনবরণ অনুষ্ঠান ছিল। তখন আমরা এক সাথেই ছিলাম। ওখান থেকে সাম্যসহ আমাদের তিনজন বন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যায়।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মন্দিরের গেটের ভেতরে একটা বসার মতো জায়গা আছে। ওই জায়গায় তিন-চারজন বহিরাগতের সাথে ওদের (সাম্য ও তার বন্ধুদের) তর্কাতর্কির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে ওর হাতাহাতিও হয়।

ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান খান জানান, শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন হয় এবং জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক তৌফিক হাসান বলেন, আমরা ওই ঘটনা নিয়ে এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছি। এরই মধ্যে তিনজনকে আটক করে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কালি মন্দিরের গেটে বহিরাগতদের সাথে কাটাকাটির একপর্যায়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে বহিরাগত আসামিরা। আমাদের প্রাথমিক যে ফাইন্ডিং তাতে যতটুকু বুঝতে পেরেছি পূর্ব কোনো শত্রুতা তাদের মধ্যে ছিল না।

ঘটনাস্থলে থাকা সাম্যর বন্ধু ও আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ধরা পড়া ৩ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।  তিনি বলেন, তাদের মধ্যে পূর্বশত্রুতা ছিল না। তুচ্ছ ঘটনা থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তবে যে তিনজনকে ধরা হয়েছে- তারা মাদক সেবনের উদ্দেশ্যে আসছিল এটা আমি শতভাগ কনফার্ম।

শাহবাগ থানার ওসি মোহাম্মদ খালিদ মনসুরের ভাষ্য, গ্রেপ্তার তিনজন পেশায় ভাসমান হকার। তাঁরা রাতে নেশা করে। আপাতত এর থেকে বেশিকিছু বলার নেই। তবে সবকিছু মাথায় রেখে তদন্ত করছে পুলিশ। ওসি বলেন, গ্রেপ্তার তিনজন মাত্র ১৫ দিন আগে মাদারীপুর থেকে ঢাকায় এসে ফুটপাতে হকারি শুরু করেছিল। তাদের একটি বাইক আছে। সারাদিন ফুটপাতে হকারি করার পর প্রতিদিন সন্ধ্যায় উদ্যানে এসে মাদক সেবন করত।