ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন সামনে রেখে ১১ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছে উমামা ফাতেমার ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল। এতে শতভাগ আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চায়ন, শিক্ষার্থীদের জন্য ন্যায্য বেতনে পার্টটাইম (খণ্ডকালীন) চাকরির সুযোগ তৈরি এবং নারী শিক্ষার্থীদের হলে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানোসহ নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে পূর্ণাঙ্গ ইশতেহার তুলে ধরেন ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী উমামা ফাতেমা। নির্বাচিত হওয়ার পরে প্রথম এক মাসে ইশতেহারে থাকা কোন কোন বিষয় বাস্তবায়ন করবেন, সেই কর্মপরিকল্পনাও করা হয়েছে বলে জানান তিনি। ইশতেহার ঘোষণার সময় প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী আল সাদী ভূঁইয়া, সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) জাহেদ আহমদসহ অন্য প্রার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
উমামা ফাতেমা বলেন, “আমাদের ইশতেহার প্রস্তুতের পেছনে অনেক গল্প আছে। ইশতেহারে শিক্ষার্থীদের চাওয়া–পাওয়াকে প্রাধান্য দিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রান্তে ‘আইডিয়া বোর্ড’ স্থাপন করি। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের মতামত দিয়েছে। সেই মতামতের ভিত্তিতেই আমরা ইশতেহার তৈরি করেছি। শিক্ষার্থীদের চাওয়া–পাওয়া তুলে ধরেছি। শুধুই কিছু কথার মধ্যেই ইশতেহার সীমাবদ্ধ রাখতে চাইনি। আমরা চেয়েছি অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে ইশতেহারে শিক্ষার্থীদের আশা–আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হোক। তাই আমরা ইশতেহারের মধ্যে কিছু ব্যতিক্রমী ও সময়োপযোগী বিষয় তুলে আনার চেষ্টা করেছি।”
ইশতেহারে বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দলীয়করণ ও বিরাজনীতিকরণ যেন আর ফিরে না আসে, সেটি নিশ্চিত করা হবে। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব ছাত্ররাজনীতি গড়ে তুলতে প্রশাসন, সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে সামাজিক চুক্তি গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া ছাত্রসংগঠনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, ইতিহাসের বিতর্কিত বিষয়গুলো একাডেমিক আলোচনায় আনা, প্রতিবছর ডাকসু নির্বাচন নিশ্চিত করা, গণরুম, আবাসনসংকট ও আর্থিক অসচ্ছলতার সমাধানের কথা বলা হয়েছে।
ইশতেহারে আরও বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবেহিলত গবেষণা খাতের বাজেট ২ থেকে ২০ শতাংশে বৃদ্ধি করতে সর্বোচ্চ উদ্যাগ নেওয়া হবে। এ ছাড়া সব বিভাগে থিসিস বা ইন্টার্নশিপ বাধ্যতামূলক করা, কোর্স কারিকুলাম হালনাগাদ, ডিজিটাল আর্কাইভ ও লাইব্রেরি উন্নয়ন, শিক্ষক মূল্যায়ন ও শিক্ষার্থী ফিডব্যাক সিস্টেম চালু করা হবে।
ক্যারিয়ার ও কর্মসংস্থান বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন, বিভাগ, সেমিনার ও লাইব্রেরিসহ উপযুক্ত কাজের জায়গায় ন্যায্য বেতনে পার্টটাইম (খণ্ডকালীন) চাকরির সুযোগ তৈরি করা হবে।
পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্যোক্তা মেলা আয়োজন, মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করা, ইউনিভার্সিটি স্টার্টআপ ইনকিউবেশন সেন্টার তৈরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে ইশতেহারে বলা হয়েছে, সম্প্রীতি রক্ষায় ধর্মীয় উৎসবের আগে–পরে দুই দিন পরীক্ষা না রাখা, ‘আদিবাসীদের’ প্রধান সামাজিক উৎসবগুলো অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারে ছুটির আওতায় আনার উদ্যোগ, বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রার্থনার জন্য কেন্দ্রীয় উপাসনালয় নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
নারীবান্ধব ও সবার জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস বিষয়ে বলা হয়েছে, নারী শিক্ষার্থীদের হলে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানো, যৌন নিপীড়ন সেলকে সর্বোচ্চ কার্যকরী করা, নারী শিক্ষার্থীদের সন্তানদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার, নারী হলগুলোর নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, নারী গেটকিপার নিয়োগ, নারী শিক্ষার্থীদের চলাফেরার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেওয়ার হবে।
ইশতেহারের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং খাদ্যসংকট নিরসন বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রতিটি হলে প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে ক্যানটিন ও ডাইনিং চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি বার্ষিক বাজেটে শিক্ষার্থীদের খাদ্যের ওপর ভর্তুকি আদায় করা, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ই-হেলথ প্রোফাইল গঠন, প্রতিটি হলে ২৪/৭ মেডিকেল সাপোর্টের ব্যবস্থা রাখা, হল ও অনুষদভিত্তিক স্থায়ী ফার্মেসি স্থাপন করা হবে।
আবাসন সমস্যা দূর করা নিয়ে বলা হয়েছে, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একটি শয্যা, একটি টেবিলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, নবীন শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আসন দেওয়া। যত দিন আসন না পাবে, তত দিন আবাসন বৃত্তির ব্যবস্থা করা, নারীদের জন্য নতুন আবাসিক হল নির্মাণে প্রশাসনের কাছ থেকে রোডম্যাপ (পথনকশা) আদায় করা হবে।
ইশতেহারের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নত করা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বাসের আপ ও ডাউন ট্রিপ বাড়ানো, পুনরায় শাটল বাস সার্ভিস চালু ও দূরবর্তী ইনস্টিটিউটগুলোর জন্য বিশেষ যানবাহনের ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ফিটনেসবিহীন বাস চলাচল বন্ধ করা, ক্যাম্পাসের ভেতরে যানজট নিরসনে নির্দিষ্ট পোশাকে রিকশা চলাচলের ব্যবস্থা করা এবং ছুটির সময়ে বিভিন্ন রুটে সরাসরি বিশেষ পরিবহনব্যবস্থা চালু রাখার কথা বলা হয়েছে।
ডিজিটালাইজেশন বিষয়ে ইশতেহারে বলা হয়েছে, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ই-লাইব্রেরি পুনরায় চালু করা, প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রমের পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজেশন নিশ্চিত করা, স্মার্ট নোটিশ বোর্ড ও মোবাইল অ্যাপ চালু, টিএসসি, হল ও অনুষদগুলোতে সাইবার সেন্টার সুবিধার ব্যবস্থা করা। অ্যালামনাইদের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করতে অ্যালামনাই ডেটাবেজ ও অ্যাপ তৈরির উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে।
খেলাধুলা ও শরীরচর্চার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব খেলার মাঠ ও সরঞ্জাম উন্নয়ন, জিমনেসিয়াম আধুনিকায়ন, সুইমিংপুলের পাশের পরিত্যক্ত মাঠ সংস্কার করে খেলার উপযোগী করা, কোটাধারী ও সাধারণ খেলোয়াড়দের মধ্যে বৈষম্য নিরসন, সম্ভাবনাময় ক্রীড়াবিদদের জন্য বৃত্তি চালুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
সর্বশেষ দফায় পরিবেশবান্ধব ক্যাম্পাস ও স্যানিটেশন বিষয়ে বলা হয়েছে, ক্যাম্পাসে পরিবেশ–পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা হবে। ময়লা ফেলার জন্য সর্বত্র ময়লার ঝুড়ি স্থাপন ও তত্ত্বাবধান করা, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, নিয়মিত ক্লিনিং ইভেন্ট (পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি) আয়োজন করা, সৌরশক্তি ব্যবহার এবং শব্দদূষণমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হবে।