বাংলাদেশের কৃষি এখন এক গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে। খাদ্যের চাহিদা বাড়লেও পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। কৃষিজমিতে ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষতিকর কীটনাশক যার অনেকটি আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ হলেও দেশে সেগুলো সহজলভ্য। কৃষকেরা নিয়ম না মেনে অতিরিক্ত বা একাধিক বালাইনাশক একসাথে প্রয়োগ করায় খাদ্যশস্যে রাসায়নিকের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, যা মানুষের দেহে জমে ক্যান্সার, কিডনি বিকল, হরমোনগত জটিলতা এবং বন্ধ্যাত্বের মতো ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।
মাটির উর্বরতা হ্রাস, পানিদূষণ এবং মাছ, মৌমাছি, গবাদিপশুসহ উপকারী প্রাণী বিনষ্ট হওয়ায় দেশের কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতও হুমকিতে পড়ছে। আইন থাকলেও বাস্তবায়ন দুর্বল। ফলে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। এ অবস্থায় কৃষককে সচেতন করা, পরিবেশবান্ধব চাষাবাদে উৎসাহ দেওয়া এবং সরকারি তদারকি জোরদারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহজাহান মঞ্জিল ও ভেটেরিনারি অনুষদের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম সম্প্রতি বালাইনাশকের প্রভাব ও বিকল্প ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
অধ্যাপক ড. শাহজাহান মঞ্জিল জানান, ‘দেশে ছত্রাকনাশকের ব্যবহার সর্বাধিক (৪৫–৪৬) শতাংশ, এরপর কীটনাশক (৩৩) শতাংশ এবং আগাছানাশক (২০–২১) শতাংশ। এগুলোর বেশির ভাগই মাটি, পানি ও বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে এই বিষাক্ত উপাদান ভূগর্ভস্থ পানি, খাল, পুকুর বা নদীতে মিশে জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। অনেকে বুঝে বা না বুঝে এমন কীটনাশক ব্যবহার করেন, যেগুলোর অর্ধ-জীবনকাল অনেক দীর্ঘ। ফলে পরিবেশে সেগুলো অনেকদিন টিকে থাকে। এতে কেঁচো, মাইট, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকসহ উপকারী অণুজীব মারা যায় এবং মাটির স্বাভাবিক উর্বরতা কমে যায়।’
সবজিভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শসায় ৫০ শতাংশ, টমেটোতে ৪০ শতাংশ, বেগুন ও ফুলকপিতে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ, আর বাঁধাকপিতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়। সবজি অল্প রান্নায় খাওয়ার ফলে এ ধরনের রাসায়নিক সহজেই শরীরে প্রবেশ করে।
অধ্যাপক শাহজাহান আইপিএম (সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা) ব্যবহারের ওপর জোর দিয়ে বলেন, একমাত্র জৈব পদ্ধতি সবসময় সম্ভব নয়, তাই বিকল্প ও টেকসই সমন্বয় দরকার। যেমন- জমি ফেলে রাখা, জৈব বালাইনাশক (ট্রাইকোডারমা, উদ্ভিদ নির্যাস), ফসলের বৈচিত্র্য, পরজীবী বা বায়োকন্ট্রোল এজেন্ট।
তিনি আরও বলেন, ‘নিম্নমানের ও চোরাই কীটনাশকের দৌরাত্ম্য বন্ধ এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও তদারকি বাড়ানো জরুরি।’
অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম জানান, ‘কীটনাশকের কারণে গরু, ছাগল ও অন্যান্য প্রাণীর দুধ, মাংস ও ডিমে রাসায়নিক জমে মানবদেহে প্রবেশ করে। বিশেষত অরগানোক্লোরিন বা লিপিডভিত্তিক কীটনাশক শরীরে জমে যায় এবং দুধ-মাংসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব, লিভার ও কিডনি সমস্যা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস এবং বোন ম্যারো নষ্টের মতো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করে।’
তিনি বলেন, ‘পশুদের শ্বাসতন্ত্র, প্রজনন এবং কোষীয় স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব কীটনাশক মানুষের শরীরে ঢুকে কোষের জেনেটিক পরিবর্তন ঘটায়, যার মিউটেশন ক্যাপাসিটি সাধারণ টক্সিক উপাদানের তুলনায় ৫১–৯১ গুণ বেশি।’
দুই গবেষকই বলেন, ‘সরকার যদি বিকল্প বালাইনাশক ব্যবহারে ভর্তুকি দেয়, তাহলে কৃষকরা পরিবেশবান্ধব উপায় বেছে নিতে আগ্রহী হবেন। একইসাথে গবেষণার জন্য বাজেট বাড়ানো, কৃষি সম্প্রসারণ ও মাঠ পর্যায়ে প্রচার জোরদার করা প্রয়োজন। এতে জনস্বাস্থ্য ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত থাকবে।’