শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রুহুল আমিন ভূঁইয়া

প্রকাশিত: মে ১৬, ২০২৫, ০৪:৩৯ এএম

বাংলা সিনেমায় নতুন স্রোত 

রুহুল আমিন ভূঁইয়া

প্রকাশিত: মে ১৬, ২০২৫, ০৪:৩৯ এএম

বাংলা সিনেমায় নতুন স্রোত 

ছবি- সংগৃহীত

অশ্লীলতা আর ভালো মানের সিনেমার অভাবে সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল দর্শক। আর সেই অন্ধকার হলে আলো জ্বালানোর উদ্যোগ নেয়নি কেউই। একে একে নিভে যায় দেশের সিনেমা হলগুলোর বাতি। নব্বই দশকে এক হাজার চারশ সিনেমা হলের মধ্যে এখন টিকে আছে মাত্র সত্তরটি সিনেমা হল। বেশির ভাগ সিনেমা হল ভেঙে তৈরি করা হয়েছে বহুতল শপিংমল।

এভাবেই পার হয় দীর্ঘ সময়। এরপর আইসিইউতে থাকা বাংলা সিনেমা যখন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ঠিক তখনই দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনার হানায় বন্ধ হয়ে যায় সব সিনেমা হল। বন্ধ হয়ে যায় সিনেমা নির্মাণ। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও নতুন সিনেমা মুক্তি দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন প্রযোজক ও পরিচালকরা। দীর্ঘদিন আটকে ছিল বড় বাজেটের বেশকিছু সিনেমা। এরপর স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বেশকিছু সিনেমা মুক্তি পেলেও সেসব সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়।

২০২২ সাল ছিল সিনেমার জন্য স্বস্তির বছর। ১২ মাসে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল ৫০টি সিনেমা। শুধু সংখ্যায় নয়, দর্শক জোয়ারেও সে বছর নিকট অতীতের রেকর্ড ভেঙেছে! ‘গলুই’, ‘শান’, ‘দিন দ্য ডে’ সিনেমা দিয়ে যে দর্শক জোয়ার শুরু হয়েছিল; সেটাকে আরও কয়েক গুণ ত্বরান্বিত করে রায়হান রাফির ‘পরাণ’ ও মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’ সিনেমা দুটি। বিশেষ করে ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’র জোয়ারে চাঙ্গা হয়ে উঠে ঢাকাই সিনেমা। নতুন করে আশায় বুক বাঁধেন প্রযোজক ও পরিচালকরা।

প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের বিগত কয়েক বছরের ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে দেয় সিনেমা দুটি। নতুন করে দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহমুখী হয়। সিনেমায় ফের সু-বাতাস বইতে শুরু করে। করোনা, প্রেক্ষাগৃহের অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে দীর্ঘদিন স্থবির ছিল ঢাকাই সিনেমা। করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দর্শক আসবেন কি না, এমন শঙ্কায় সিনেমা মুক্তি নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন প্রযোজক ও পরিচালকেরা। কিন্তু সব হতাশা দূর করে ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’।

এরপর বাংলা সিনেমা নিয়ে রীতিমতো উন্মাদনা তৈরি হয়। ফের সিনেমা হলে বন্ধুবান্ধব ও পরিবার নিয়ে ভিড় করতে থাকেন দর্শকরা। এরপর ‘প্রিয়তমা’ ও ‘সুড়ঙ্গ’ দিয়ে ফের সিনেমা হলের হারানো প্রাণ ফিরে আসে। ‘প্রিয়তমা’ সিনেমাটি রেকর্ড পরিমাণ আয় করে। এরপর ‘রাজকুমার’ সিনেমাটিও বাজিমাত করে। সর্বশেষ গত রোজার ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘বরবাদ’ সিনেমা সবকিছু ‘বরবাদ’ করে দেয়। সিনেমা হলে দর্শকদের ঢল নামে। মুক্তির এক মাস পেরিয়ে গেলেও টিকিট না পেয়ে ফিরে গেছেন অনেক সিনেপ্রেমীরা।

‘বরবাদ’ মুক্তির নবম দিনের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের হালনাগাদ তথ্য মতে, সাত দিনে ‘বরবাদ’ সিনেমার টিকিট বিক্রি থেকে আয়ের পরিমাণ ২৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। তাদের দাবি, ‘বরবাদ’র আয় ছুঁতে পারে ১০০ কোটি! এর আগে ২০২৩ সালের ঈদুল আজহায় শাকিব খান অভিনীত ‘প্রিয়তমা’ সিনেমাটি এক মাসে ২৭ কোটি টাকার টিকিট বিক্রির খবর প্রকাশ করেছিল। মাত্র সাত দিনেই ‘বরবাদ’ সেই সাফল্যে পৌঁছে যায়। ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ‘বরবাদ’ সিনেমাটি এখন পর্যন্ত ৮৫ কোটি টাকা ঘরে তুলেছে বলে জানিয়েছেন প্রযোজক। সিনেমাটি এখনো সগৌরবে চলছে। এরপর ‘জংলি’ সিনেমাটিও সন্তোষজনক ব্যবসা করে যাচ্ছে। বরবাদের প্রযোজক আশা করছেন, শিগগিরই তারা একশ কোটির ক্লাবে পা রাখবেন! চলচ্চিত্রের নানা সংকট ও উত্তরণ নিয়ে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা হয় সংশ্লিষ্টদের।

‘বরবাদ’ সিনেমার প্রযোজক শাহরিন আক্তার সুমি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমার সময় বাদ দিলে বরবাদ দেশের সবচেয়ে বড় বাজেটের ও ব্যবসাসফল সিনেমা। বাংলাদেশে এ ধরনের সিনেমা এর আগে তৈরি হয়নি। আমার পরবর্তী সিনেমা ১৫ কোটির চেয়ে বেশি বাজেট রাখা হচ্ছে। বর্তমানে তার প্রস্তুতি চলছে। আমি বড় বাজেটের বাইরে ছোট বাজেটে সাধারণ সময়ের জন্যও কিছু সিনেমা প্রযোজনা করব। তবে সবার আগে সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। টিকিটের সঠিক হিসেব পাওয়া যায় না। প্রতিটি হলে এক মাস বরবাদের টিকিট পাওয়া যায়নি। উপচে পড়া ভিড় থাকার পরও আমরা সঠিক হিসাব পাচ্ছি না। এমন চলতে থাকলে শুধু আমিই না অন্যরাও মুখ ফিরিয়ে নেবে।’

যোগ করে এই প্রযোজক আরও বলেন, ‘এটা সত্যি যে আমাদের সিনেমা এখন ঈদকেন্দ্রিক। ঈদ ছাড়া কেউ সিনেমা মুক্তি দিতে চায় না। কারণ, অন্য সময় দর্শক হলে যাচ্ছে না। তা ছাড়া লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত আসে না। যে কারণে সবাই ঈদ টার্গেট করে সিনেমা বানাচ্ছেন। যখন আমাদের সিস্টেম পরিবর্তন হবে তখন সারা বছরই সিনেমা মুক্তি পাবে। প্রযোজকের ন্যায্য হিসাবে পেতে ই-টিকিটিং চালু করতে হবে। অন্যথায় দিন দিন প্রযোজকরা মুখ ফিরিয়ে নিবে। সিনেমা শিল্প বাঁচাতে প্রযোজকদের এগিয়ে আসতে হবে।’

পরিচালক সমিতির সভাপতি শাহীন সুমন বলেন, ‘এখন ঈদ ছাড়া সিনেমা মুক্তি পায় না এবং চলেও না। আগে ১৪০০ সিনেমা হল ছিল। এখন সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬০-৭০ ঘরে। ক্রমেই হল কমছে। এতে করে আমরা যারা এই অঙ্গনে আছি ঝুঁকিতে পড়ছি। ঈদ ছাড়াও সিনেমা মুক্তি দিতে হবে। সিনেমা হল নির্মাণ ও আধুনিকায়নের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। বরাবরই বাজেটে চলচ্চিত্র উপেক্ষিত থাকে। কখনোই সিনেমার জন্য বাজেট থাকে না। সামনেই যেহেতু বাজেট বর্তমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে তিনি যাতে বিষয়টি বিবেচনায় রাখে। বাজেটে চলচ্চিত্রের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে।

এ ছাড়া বিগত বছরে আমরা দেখেছি বাণিজ্যিক সিনেমার নির্মাতারা অনুদান পায় না। অফট্রাকের গল্পের সিনেমার জন্য অনুদান দেওয়া হয়। নামেমাত্র একটি হলে কিংবা সিনেপেক্সে সেসব সিনেমা মুক্তি পায়, যা নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ থাকে না। বর্তমান উপদেষ্টা ও তথ্য উপদেষ্টার কাছে আহ্বান থাকবে এবার যাতে বাণিজ্যিক সিনেমার নির্মাতারা অনুদানে গুরুত্ব পায়। তাহলেই আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প আরও ঘুরে দাঁড়াবে।’

বরিশালে আগে পাঁচটি সিনেমা হল থাকলেও এখন কেবল টিকে আছে ‘অভিরুচি’ নামের একটি মাত্র হল। সেখানে এই ঈদে ‘বরবাদ’ চলছে। দুই ঈদ ছাড়া বছরের অন্য সময়ে ‘ভালো সিনেমা আসে না’ জানিয়ে এই হলের ব্যবস্থাপক রেজাউল কবির আক্ষেপ করে বলেন, ‘সারা বছর সিনেমা হল কেমন চলছে, আছে নাকি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে- এই খোঁজটাও কেউ নেয় না। চলচ্চিত্রের সব উন্নয়ন এফডিসিকেন্দ্রিক। একসময় দেখা যাবে প্রযোজকদেরও সিনেমা তৈরি করে মুক্তির জন্য হলও তৈরি করতে হবে। তাই এক ঈদ সিনেমা ভালো চলেছে এই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার চেয়ে এই ভালো চলা নিয়মিত হওয়ার উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’

ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসার সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল। তার কথায়, ‘কেবল ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা দিলে হবে না। বছরে ৩০টা সিনেমা হোক, ভালো গল্পের পাঁচ-ছয়টি হিট সিনেমা দিলে হলের পরিস্থিতি ফিরবে। হলে দর্শক ফিরলে হল সংস্করণ, সিনেমার উন্নয়নসহ সব কাজ করা সম্ভব হবে।’

শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর বলেন, ‘সিনেমা বাঁচাতে বছরে কম পক্ষে বড় বাজেটের ১৪টি সিনেমা লাগবে। বছরজুড়ে এসব সিনেমা মুক্তি পেলে দর্শক হলমুখি থাকবে।’ প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস বলেন, ‘এবার ঈদে সিনেমার যে ‘ভালো ব্যবসা’ হয়েছে, সেটির ধারাবাহিকতা ধরে রাখা দরকার।’

লায়ন প্রেক্ষাগৃহের কর্ণধার মির্জা আব্দুল খালেকের কাছে প্রশ্ন ছিল, ঢাকাই সিনেমার সুদিন ফিরছে বলে তিনি মনে করেন কি না। তিনি বলেন, ‘সুদিন ফিরছে কি না এখনই বলা যাচ্ছে না, গত কোরবানি ঈদের পর তো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হলো। আগস্টের পর থেকে ঈদের আগ পর্যন্ত আমি আমার সিনেমা হলে প্রায় বেয়াল্লিশ লাখ টাকা পুঁজি ঘাটতি দিয়েছি। মানে স্টাফ খরচ, বিল সব মিলিয়ে লসে সিনেমা হল চালিয়েছি। এই ঈদে সিনেমা খুব ভালো গেছে। তবে তাতে আমার যে আট মাসের ব্যবসায়িক লস সেটা উঠানো গেল কী?

দেশের প্রযোজক, নির্মাতারা শুধু ঈদ উৎসব ঘিরে সিনেমার কথা ভাবেন, এই বিষয়টিকে চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য ‘সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার’ বলেও মনে করছেন লায়ন প্রেক্ষাগৃহের কর্ণধার। বগুড়ার মধুবন সিনেপ্লেক্সের মালিক রোকনুজ্জামান ইউনূস বলেন, ‘প্রদর্শক ও প্রযোজক এক কাতারে না আসলে দেশের চলচ্চিত্র বলে কিছু থাকবে না। সিনেমা হল বন্ধ করার ঐক্য না করে, হল বৃদ্ধির ঐক্য করতে হবে। তবেই চলচ্চিত্র বাঁচবে।’

ব্যাবসায়িক সাফল্য ধরে রাখতে চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ন, নির্ভরযোগ্য বণ্টনব্যবস্থা এবং দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো চান তারা। অপরদিকে ঈদে ‘ভালো ব্যবসা’ হলেও ‘মৌসুমি’ এই সাফল্য দিয়ে সারা বছরের লোকসান কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না বলে জানিয়েছেন হল মালিকরা। ঈদ ঘিরে ব্যবসার যে সাফল্য, তার ধারাবাহিকতা বছরজুড়ে ধরে রাখার তাগিদ দিয়েছেন হল মালিক এবং প্রদর্শক সমিতির কর্তারা। অন্যদিকে, পরিচালক ও শিল্পী নেতারা বলছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কথা। তবে সবাই জোর দিয়েছেন বছরজুড়ে ভালো বাজেটের সিনেমা মুক্তি দিতে হবে এবং প্রযোজকের সঠিক হিসাব পেতে ই-টিকিটিং চালুর উদ্যোগ নেওয়ার।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!