প্রেম—শব্দটা যতবার উচ্চারিত হয় ততবারই নতুন অর্থ তৈরি হয়। কারও কাছে প্রেম মানে আকর্ষণ, কারও কাছে যত্ন, কারও কাছে আবার নিঃশব্দে পাশে থাকা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কবি, দার্শনিক, মনীষীরা প্রেমকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটিই সত্য হয়ে থেকেছে—প্রেমকে পুরোপুরি সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। এটি একসঙ্গে আনন্দ আর বেদনা, উপস্থিতি আর অনুপস্থিতি, শুরু আর শেষের রহস্যময় সমন্বয়।
‘অক্টোবর’ আসলে কোনো প্রচলিত প্রেমের গল্প নয়। এখানে নেই প্রস্তাব, প্রতিশ্রুতি, কিংবা স্বপ্নময় ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। বরং আছে নিঃশর্ত উপস্থিতি, এক অদ্ভুত টান, আর ভালোবাসার এমন এক রূপ যা বলা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়।
ড্যান। এক তরুণ হোটেল ম্যানেজমেন্ট ইন্টার্ন। দায়িত্বজ্ঞান তার খুব একটা পছন্দ নয়—ডিউটি ফাঁকি দেওয়া, কাজের সময় গা–ঢিলা করা, হোটেল ব্যবস্থাপনার সূক্ষ্ম শৃঙ্খলার সঙ্গে তার যেন কোনো খাপ খায় না। তার সহকর্মীরা যখন কাজে ব্যস্ত, তখন ড্যান উদাসীন ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করে। কিন্তু এই ছেলেমানুষি আচরণের আড়ালেই লুকিয়ে থাকে একধরনের নিষ্পাপ কৌতূহল, যা তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তোলে।
এই সহকর্মীদের ভিড়েই আছে শিউলি—শান্ত, অন্তর্মুখী, সংযত স্বভাবের এক তরুণী। ড্যান আর শিউলির মধ্যে কোনো সরাসরি প্রেম কিংবা বিশেষ সম্পর্ক শুরু হয় না। দুজন প্রায় আলাদা জগতের বাসিন্দা। তবু একদিনের হঠাৎ দুর্ঘটনা সবকিছু ওলটপালট করে দেয়।
ঘটনাচক্রে একদিন এক মুহূর্তের অসতর্কতায় শিউলি ছাদ থেকে পড়ে যায়। ড্যান তখন ধারেকাছে কোথাও ছিল না। মারাত্মক আহত অবস্থায় শিউলিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিছু সময়ের মধ্যেই সে কোমায় চলে যায়। বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীরা শিউলির খবর নিতে আসে, কিছুদিন তার পাশে থাকে। সময় গড়ায়, সবার জীবন ধীরে ধীরে নিজের গতিতে ফিরতে শুরু করে।
কিন্তু ড্যান যেন সেই জায়গায় আটকে যায়। এক সহকর্মীর মাধ্যমে ড্যান জানতে পারে, পড়ে যাওয়ার আগে শিউলির বলা শেষ কথা ছিল, ‘ড্যান, কোথায়?’
সেখান থেকেই শুরু হয় ড্যানের নীরব যাত্রা। প্রতিদিন নিয়মিত সে হাসপাতালে যায়, শিউলির পাশে বসে থাকে। ডাক্তারদের সঙ্গে পরামর্শ করে, নার্সদের খোঁজ নেয়, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়ে। তার এই অদম্য উপস্থিতি আশেপাশের সবাইকে অবাক করে দেয়। সম্পর্কের কোনো সামাজিক সংজ্ঞা নেই, কোনো প্রত্যাশা নেই—তবু ড্যান যেন নিজের অস্তিত্বই শিউলির সঙ্গে বেঁধে ফেলেছে।
শিউলির অবস্থার ওঠানামার সঙ্গে ড্যানের জীবনও পরিবর্তিত হতে থাকে। আগে যে তরুণ দায়িত্ব এড়িয়ে চলত, সে এখন নিয়মিত হাসপাতালের করিডরে রাত কাটায়। হোটেল ম্যানেজমেন্টের চাকরির প্রতি তার আগ্রহ কমে যায়, কিন্তু জীবনের প্রতি এক নতুন দায়বদ্ধতা জন্ম নেয়। শিউলির প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস, প্রতিটি নড়াচড়া যেন ড্যানের নিজের জীবনের সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
অবশেষে, শিউলির অবস্থা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। কিন্তু মৃত্যুর পরও তার অনুপস্থিতি ড্যানের ভেতরে এক গভীর ছাপ ফেলে যায়। যে ড্যান একসময় দিশেহারা, উদাসীন এক তরুণ ছিল, সে হয়ে ওঠে এক মানবিক, পরিণত, আর জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া মানুষ।
শিউলির মৃত্যু নিয়ে সিনেমার প্রথম দৃশ্যই চোখে জল এনে দেয়। নির্জন, শোকস্তব্ধ বাড়ির ভেতর ড্যান পা টিপে টিপে ঢুকে যায়। সে মৃত শিউলির বেডের পাশে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। জানালার ওপাশে আলো প্রবাহিত হচ্ছে, আর ড্যানের চোখে ছলছল করে জল। মুহূর্তটি নিঃশব্দ, নিঃসঙ্গ, এমনভাবে হৃদয়কে স্পর্শ করে যে এখানেই সিনেমা শেষ হতো।
কিন্তু ‘অক্টোবর’ তার শেষ রেশটিও ছেড়ে দেয়। বহু বছর পর, ড্যান এখন পরিণত, দায়িত্ববান, কর্মঠ ও পরিশ্রমী এক যুবক। শিউলির মা তাকে জানান—তারা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু শিউলির সেই প্রিয় গাছটা ফেলে যাওয়া সম্ভব নয়। ড্যান তখন নিঃশব্দে প্রতিশ্রুতি দেয়—‘আমি গাছটা সঙ্গে নিয়ে যাব।’
ড্যান সেই গাছ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। শিউলির সঙ্গে সম্পর্ক আর তার স্মৃতির নিঃশব্দ সংযোগে এই ছোট্ট কাজটিই একপ্রকার রেশ হয়ে দাঁড়ায়। সিনেমার শেষটি শুধু শোক নয়, বরং ভালোবাসা ও স্মৃতির স্থায়িত্বের একটি নিখুঁত চিহ্ন।
এক বাক্যেই অক্টোবরের গল্প বর্ণনা করেছিলেন সুজিত— ‘অক্টোবর’ ইজ নট অ্যা লাভ স্টোরি, ইটস অ্যা স্টোরি অ্যাবাউট লাভ।

সুজিত সিরকারের অক্টোবর মূলত প্রচলিত বলিউড ফর্মুলা ভেঙে দেওয়া এক সিনেমা। এখানে নেই চটকদার গান, প্রেমিক-প্রেমিকার দৌড়ঝাঁপ, বা নাটকীয় মোড়। বরং আছে নীরবতা, অপেক্ষা আর মানুষের ভেতরে ধীরে ধীরে ঘটে যাওয়া এক পরিবর্তনের গল্প।
শিউলি ফুল একদিন ঝরে যায়, কিন্তু তার সৌরভ থেকে যায়—একইভাবে শিউলি চরিত্রও দুর্ঘটনার পর জীবনের স্বাভাবিক গতি হারালেও, তার উপস্থিতি আর প্রভাব ড্যানের মধ্যে থেকে যায়। ফুলের মতোই ক্ষণস্থায়ী, ভঙ্গুর অথচ গভীর ছাপ ফেলে যায়। শরৎকালে গাছ থেকে পাতা ঝরে—এটা জীবন আর মৃত্যুর মাঝের এক রূপক। ছবিতে শিউলির অবস্থা (মৃত্যুর ছায়ায় ঝুলে থাকা) আর ড্যানের তার পাশে থেকে যাওয়া—ঋতুচক্রের মতোই অনিবার্য, কিন্তু গভীর।
কাহিনি ও নির্মাণ
একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন ইন্টার্ন ড্যান (বরুণ ধাওয়ান), আর তার সহকর্মী শিউলি (বানিতা সান্ধু)। এক দুর্ঘটনায় শিউলি কোমায় চলে গেলে তার চারপাশের মানুষ ধীরে ধীরে তাকে ভুলতে শুরু করে। কিন্তু ড্যান যেন নিজের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেই তাকে ধরে রাখে। তার এই নিরলস উপস্থিতি সিনেমাটিকে এক গভীর মানবিকতার দিকে নিয়ে যায়।
অভিনয়
বরুণ ধাওয়ান এখানে তার ক্যারিয়ারের সেরা অভিনয় দিয়েছেন। বাণিজ্যিক নায়কের চাকচিক্য বাদ দিয়ে তিনি একদম সাধারণ, কিন্তু গভীর মানবিক তরুণের ভূমিকায় হাজির হয়েছেন। বানিতা সান্ধু খুব কম ডায়ালগে থেকেও চরিত্রে এক ধরনের রহস্যময় সৌন্দর্য রেখে গেছেন।
চিত্রগ্রহণ ও আবহ
শিউলি ফুল, হাসপাতালের নির্জনতা, শহরের শীতল দৃশ্য—সব মিলিয়ে ক্যামেরা এখানে চরিত্র হয়ে উঠেছে। সংগীত ও শব্দের ব্যবহারও সংযমী, যেন দর্শককে ধ্যানমগ্ন এক অবস্থায় নিয়ে যায়।
মূল শক্তি
অক্টোবর-এর শক্তি হলো এর নীরবতা। সিনেমা বারবার মনে করিয়ে দেয়, ভালোবাসা মানেই উচ্চারণ নয়; অনেক সময় ভালোবাসা বোঝায় কারও পাশে থাকা, কথা না বলেও সঙ্গ দেওয়া।
দুর্বলতা
বাণিজ্যিক দর্শকের কাছে সিনেমাটি ধীর মনে হতে পারে। গতি-নির্ভর কাহিনি খুঁজলে অনেকেই বিরক্ত হবেন।
সামগ্রিক মূল্যায়ন
‘অক্টোবর’ কোনো মেইনস্ট্রিম রোম্যান্টিক ফিল্ম নয়; এটা এক অভিজ্ঞতা, এক নিস্তব্ধ যাত্রা। যাদের সিনেমা মানেই বিনোদন, তাদের কাছে এটি ধীরগতির মনে হতে পারে। কিন্তু যারা সিনেমায় জীবনের প্রতীক, অপেক্ষার সৌন্দর্য, আর ভালোবাসার নিঃশর্ত রূপ খুঁজতে চান—তাদের জন্য ‘অক্টোবর’ এক অনন্য সৃষ্টি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন