বুধবার, ০১ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: অক্টোবর ১, ২০২৫, ০৫:০১ পিএম

আইফোন থেকে ধর্ষণ মামলা, অস্বচ্ছ কথিত মডেলের বয়ান

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: অক্টোবর ১, ২০২৫, ০৫:০১ পিএম

তাছলিমা খাতুন আয়েশা ও নাট্যনির্মাতা নাসির উদ্দিন মাসুদ। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

তাছলিমা খাতুন আয়েশা ও নাট্যনির্মাতা নাসির উদ্দিন মাসুদ। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

গাজীপুরের শ্রীপুরে নাট্যনির্মাতা নাসির উদ্দিন মাসুদ ও তার সহযোগীর বিরুদ্ধে সম্প্রতি ধর্ষণের অভিযোগ তুলেছেন মডেল পরিচয়ধারী তাছলিমা খাতুন আয়েশা। তবে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে তার দেওয়া তথ্যের বেশিরভাগই অসত্য ও পরস্পরবিরোধী প্রমাণিত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, পরিচালককে ফাঁসানোর উদ্দেশ্যেই তিনি এই মামলা করেছেন!

অভিযোগের শুরুতে আয়েশা দাবি করেছিলেন, পূবাইলে শুটিং চলাকালে পরিচালক নাসির উদ্দিন মাসুদ তার মোবাইল নম্বর নেন এবং পরবর্তীতে তাদের একসঙ্গে দু-একটি নাটকের শুটিংও হয়।

তবে সম্প্রতি তাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলে তিনি নিজেই বলেন, ওই পরিচালকের সঙ্গে এর আগে কোনো কাজই হয়নি। এমন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য তার অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সেই সঙ্গে পরিচালক মাসুদও নিশ্চিত করেছেন, কথিত এই অভিনেত্রীর সঙ্গে কখনো তার কাজ হয়নি।

গণধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর আয়েশার ব্যবহার করা আইফোন ১৬ প্রো ম্যাক্স নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়। যারা তাকে আগে কখনো উল্লেখযোগ্য কোনো কাজে দেখেননি তাদের কৌতূহল ছিল, প্রথম সারির মডেল বা অভিনেত্রী না হয়েও এত দামি ফোন তিনি পেলেন কীভাবে!

দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের প্রশ্নের জবাবে আয়েশা বলেন, মডেলিংয়ের আগে চাকরি করতেন তিনি এবং ব্যাংকে কিছু সঞ্চয় ছিল। পরে পরিচিত এক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় আড়াই লাখ টাকা দিয়ে ফোনটি কেনেন। তবে ফোনটির কোনো কেনাবেচার নথি তার কাছে নেই বলে স্বীকার করেন। স্বল্প বেতনের চাকরি থেকে সঞ্চিত টাকায় এত দামি ফোন কেনার দাবি বাস্তবসম্মত কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

শত চেষ্টা সত্ত্বেও আয়েশার কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু তার ফেসবুক প্রোফাইলে একটি গানের শুটিংয়ের সময় তোলা কিছু ছবি চোখে পড়ে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি পোস্টে দেখা যায়, একটিতে আইফোনের পাশে আরেকটি স্মার্টফোন ও দামি একটি ঘড়ির ছবি দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমার পছন্দের জিনিস’।

আরেক পোস্টে হোটেলের বেডরুমে তোলা কয়েকটি সেলফি প্রকাশ করে ক্যাপশনে উল্লেখ করেছেন ‘সোনারগাঁও’। আসলেই এটি রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি নিশ্চিত করেছেন যে ছবিগুলো ওই হোটেলেই তোলা।

এ ছাড়াও আয়েশার ফেসবুকে বিভিন্ন হোটেলের বেডরুমে তোলা ছবিও পাওয়া গেছে। এসব ছবির ক্যাপশনে কোথাও লেখা রয়েছে ‘ঢাকা টু কক্সবাজার’, আবার কোথাও ‘বসুন্ধরা সিটি’। সোনারগাঁও হোটেলের ছবি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রথমে উত্তেজিত ও ক্ষুব্ধভাবে প্রতিক্রিয়া জানান। পরে বলেন, ‘যখন আওয়ামী লীগ ছিল, তখন আমার অনেক মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল, সেসব সময়ই ছবিগুলো তোলা।’

তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, যেখানে ঢাকায় শুটিং হলে সাধারণত কোনো অভিনয়শিল্পী পাঁচ তারকা হোটেলে অবস্থান করেন না, সেখানে তিনি এত দামি হোটেলে কী করছিলেন? কক্সবাজারের হোটেলে তোলা ছবিগুলোও কি সত্যিই শুটিংয়ের সময়ের, নাকি ব্যক্তিগত ভ্রমণের জন্য, এ নিয়েও সংশয় রয়েছে।

আলোচিত এই কথিত মডেল নিজেই স্বীকার করেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় তার অনেকের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল। তবে সেই ‘অনেক মানুষ’ কারা এবং কী কারণে তার এমন ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেননি তিনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, ঠিক কোন সম্পর্কের সূত্রে তিনি এত দামি হোটেলে যাতায়াত করতেন।

গণমাধ্যমে আয়েশা নিজেকে ‘অভিনয়শিল্পী’ দাবি করে বলেছেন, নাটকে অভিনয় করেছেন এবং তার যথাযথ প্রমাণ রয়েছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি কিছুটা নীরব থাকার পর জানান, চলতি বছরে দুইটি গানের মডেল হিসেবে কাজ করেছেন এবং গত দুই বছরে মোট ছয়টি কাজে যুক্ত ছিলেন, যার মধ্যে একটি নাটকে অভিনয় করেছেন বলে দাবি করেন। কিন্তু অনুসন্ধানে তার অভিনীত কোনো উল্লেখযোগ্য কাজের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

আয়েশা দাবি করেছেন, তিনি পাঁচটি গানের মডেলিং ও একটি নাটকে অভিনয় করেছেন। তবে কাজের তালিকা বা প্রমাণ চাইলে কেবল একটি মিউজিক ভিডিওর নাম উল্লেখ করতে সক্ষম হন। বাকি কাজগুলোর কোনো প্রমাণ তিনি দিতে পারেননি।

নাটক প্রসঙ্গে তার দাবি, এটি একটি ‘বিগ বাজেটের’ নাটক, যা এখনো প্রকাশিত হয়নি এবং মাত্র একদিনেই শুটিং সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে তিনি পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলেও দাবি করেন।

কিন্তু নাটকটির নায়কের নাম বললেও নায়িকার নাম বলতে পারেননি। আরও খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তার উল্লেখ করা নায়কের নামের সঙ্গে মিলিয়ে কোনো শিল্পীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। একইভাবে নাটকটির পরিচালকের নাম হিসেবে ‘সাইফুল’ বললেও তিনি সম্পূর্ণ নাম জানাতে ব্যর্থ হন।

গণমাধ্যমে আয়েশা জানিয়েছিলেন, তার বাড়ি কেরানীগঞ্জ। তবে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ তার জাতীয় পরিচয়পত্রের অনলাইন কপি যাচাই করলে দেখা যায়, এনআইডিতে স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা হিসেবে লেখা রয়েছে, বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার মিঠাখালী ইউনিয়ন।

এ ছাড়া এজাহারে তার স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে চট্টগ্রামের বুজপুর উপজেলা। কথোপকথনের সময় তিনি জানান, কেরানীগঞ্জে থাকা বাড়িটি তার বোনের। এ তথ্যগুলো তার দেওয়া ঠিকানার সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছে।

নিজেকে চট্টগ্রামের বাসিন্দা দাবি করলেও আয়েশার জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা হিসেবে বাগেরহাটের নাম রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, বাগেরহাটে তার বোনের বিয়ে হয়েছিল এবং সে সময় অল্প বয়সে চাকরির প্রয়োজন হওয়ায় সেখান থেকেই এনআইডি নিবন্ধন করেন।

তবে কথোপকথনের একপর্যায়ে তিনি আবারও ভিন্ন কথা বলেন, তার বোনের বাড়ি নাকি বাগেরহাট সাতক্ষীরা। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি নিশ্চিত করেন, আসলেই তার বোনের বাড়ি সাতক্ষীরা। কিন্তু তবুও এনআইডি নিবন্ধন বাগেরহাট থেকেই করেছেন বলে জানান।

এনআইডিতে জন্মস্থান ও ঠিকানা বাগেরহাট উল্লেখ থাকলেও আয়েশার দাবি, তার জন্ম ও বসবাস চট্টগ্রামে। এ ছাড়া তিনি আরও জানান, চট্টগ্রামে একটি কওমি মাদ্রাসায় আট জামাত পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।

এত দীর্ঘ সময় চট্টগ্রামে পড়াশোনা করেও কেন তিনি জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধন বাগেরহাট থেকে করেছেন, এ প্রশ্নের উত্তর এখনো অস্পষ্ট রয়ে গেছে।

গণধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করার পর আয়েশা সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেন, রাত তিনটার দিকে তিনি ওই রিসোর্টে পৌঁছান এবং এরপর গণধর্ষণের শিকার হন। তার বর্ণনা অনুযায়ী, তাকে যেই প্রাইভেটকারে বাসা থেকে রিসোর্টে আনা হয়েছিল, সেই একই প্রাইভেটকারে তাকে এয়ারপোর্ট এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়।

অন্য একটি গণমাধ্যমে তিনি আরও জানান, গণধর্ষণের পর সকালে পরিচালক নাসির উদ্দিন মাসুদ তার পা ধরে ক্ষমা চেয়েছিলেন। এরপর প্রমাণ সংগ্রহের জন্য তিনি সুইমিং পুলে নেমে পরিচালক নাসিরের সঙ্গে ছবি তুলেছেন।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এ বর্ণনাকে বাস্তবসম্মত মনে করছেন না। ভুক্তভোগীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থার ওপর তারা মত দেন, ধর্ষণের পর নারী সাধারণত আতঙ্ক, শক, লজ্জা ও অসহায়ত্বে ভুগেন এবং মানসিকভাবে ট্রমার মধ্যে থাকেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ধর্ষকের সঙ্গে পুনরায় স্বেচ্ছায় মিশে যাওয়া, সুইমিং করা বা ছবি তোলা প্রায় অসম্ভব।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ধর্ষণের প্রমাণ সংগ্রহের জন্য মেডিকেল পরীক্ষা ও পুলিশি তদন্তই প্রয়োজন, তাই আয়েশার বর্ণিত আচরণকে তারা অযৌক্তিক ও অবাস্তব বলে উল্লেখ করেছেন।

অনুসন্ধানের একপর্যায়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রতিবেদনে দেখা যায়, কথিত মডেলের একাধিক বক্তব্যে গড়মিল ধরা পড়ায় স্থানীয়দের মধ্যে নানা প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। মামলার পাশাপাশি ‘আইফোন হারানো’ বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। প্রতিবেদনে তার ভাষ্য উদ্ধৃত করা হয়েছে, ‘আমার সঙ্গে যা হয়েছে তাতে কষ্ট নেই, সবচেয়ে কষ্ট হয়েছে আইফোন নিয়ে গেছে বলে।’

থানার এসআইও জানান, গত বৃহস্পতিবার ভোর রাতে ওই নারী প্রথমেই থানায় এসে আইফোন হারানোর অভিযোগ করেছেন। এই তথ্য অনুযায়ী প্রশ্ন, গণধর্ষণের অভিযোগ কি আইফোন হারানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করেই উত্থাপিত হয়েছে?

উল্লেখ্য, অভিযোগকারীর মোবাইল ফোন ও হোটেল অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে নানা অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। তার দাবি অনুযায়ী গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা তার বর্ণনাকে বাস্তবসম্মত মনে করছেন না। মামলার পাশাপাশি স্থানীয়দের মধ্যে আইফোন হারানোর ঘটনা এবং অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নও সৃষ্টি হয়েছে।

Link copied!