বলিউডের ‘মেগাস্টার’ শাহরুখ খান ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে বিলিয়নেয়ারের মর্যাদা অর্জন করেছেন। ভারতের ধনী তালিকা অনুযায়ী, তিনি বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র ০.০০০০৪ শতাংশের অন্তর্ভুক্ত একটি অভিজাত ক্লাবে যোগদানকারী প্রথম বলিউড তারকা। ভারতের ৩৫৮ জন বিলিয়নেয়ারের একজন হিসেবে, অথবা ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.০০০০২ শতাংশের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে, তিনি এই সম্মান অর্জন করেছেন। ভারতের গণমাধ্যম তার কৃতিত্ব উদযাপন করেছে, তার বৈচিত্র্যময় পোর্টফোলিও, ব্যবসায়িক দক্ষতা, অনন্য প্রতিভা এবং ক্যারিশমা তুলে ধরেছে।
ইন্ডিয়া টুডে লিখেছে, ‘এই অর্জন বছরের পর বছর ধরে নিরলস পরিশ্রমের মুকুট, যা তার ব্র্যান্ডকে একটি শক্তিশালী সম্পদের ইঞ্জিনে পরিণত করেছে।’
হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে, ‘শাহরুখ খানের কোটিপতিদের ক্লাবে প্রবেশ করা মাথা এবং হৃদয়ের জন্যই যৌক্তিক।’
দ্য ইকোনমিক টাইমস উল্লেখ করেছে, ‘তার যাত্রা প্রমাণ করে যে প্রতিভা, কঠোর পরিশ্রম এবং বুদ্ধিমান বিনিয়োগ পর্দায় এবং পর্দার বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই স্থায়ী উত্তরাধিকার তৈরি করতে পারে।’
তবে এ বছরে শাহরুখ খানের কোটিপতি হওয়ার প্রেক্ষাপটটি খুব কম মানুষই গুরুত্বসহকারে দেখছেন। কারণ এমন এক সময় তিনি ভারতে বিলিয়নেয়ার হলেন, যখন দেশটিতে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, মধ্যবিত্তের জন্য কাজের সুযোগ কমছে, এবং ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে জনগণ বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি।
গাজা ও কাশ্মীরের পরিস্থিতি এবং ভারতের সামাজিক উত্তরণের প্রেক্ষিতে খান সাহেবের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, সম্পদের বৃদ্ধি যদি সমাজকে নতুনভাবে আলোকিত করতে না পারে, তাহলে তার লাভ কী?
শাহরুখ খানের সম্পদের গল্প বোঝার জন্য ভারতের ১৯৯০-এর পরের অর্থনৈতিক ইতিহাসকে খতিয়ে দেখতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবেশের সঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদ একটি নতুন দিক নেয়, যা হিন্দি সিনেমার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়। শাহরুখ খান অতীতের সংরক্ষণবাদী ও মুক্তবাজার ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন হয়ে ওঠেন। তার সাফল্য মূলত স্বজনপ্রীতির শিল্পে আশার গল্প হিসেবে প্রকাশ পায়।
যখন হিন্দু জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে পড়ে, তখন খানের চলচ্চিত্রে অভিনীত চরিত্রগুলো ধর্মীয় ও বর্ণগত বিভাজন ঢাকতে সাহায্য করে এবং বৈষম্যকে ব্যক্তিগত দায়িত্ব থেকে আলাদা করে।
তিনি সাধারণ মানুষ হিসেবে তৈরি হন, যা দর্শককে আশ্বাস দেয়। এটিই তার সাফল্য এনে দেয়, পাশাপাশি ভারতীয়কে বিশ্বজনীন করে তোলে।
বিনোদন সাংবাদিকরা উল্লেখ করেছেন, খানের ব্যক্তিগত জীবন ভারতের ধারণার প্রতিফলন ঘটায়। তিনি একজন মুসলিম পুরুষ, হিন্দু স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহিত, এবং সন্তানরা নিজের ইচ্ছামত ধর্ম গ্রহণ করছে।
শাহরুখ খান তার চলচ্চিত্র ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভারতীয় হিন্দুদের আশ্বস্ত করেছেন যে মুসলিম হওয়া ভারতীয় হওয়ার সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তিনি অ-হুমকিপ্রবণ, ভোক্তা-বান্ধব, দেশের প্রতি আনুগত্যশীল। ডানপন্থিদের বিরক্তি সত্ত্বেও, তার নীরবতা ও সমন্বয়বদ্ধ আচরণ উদারপন্থি বামপন্থিদের কাছেও শ্রদ্ধা অর্জন করেছে।
২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ক্ষমতায় আসার পর ভারতের মুসলিমরা ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার মধ্যে জীবনযাপন করছিল। এই সময়ে শাহরুখ খান বড় কোনো মন্তব্য করেননি। তার সম্পদ বৃদ্ধি তার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। রেড চিলিজ এন্টারটেইনমেন্ট ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কলকাতা নাইট রাইডার্স, যেখানে জুহি চাওলা সহ-সহমালিক, আইপিএলের সবচেয়ে লাভজনক দলগুলোর মধ্যে একটি।
২০১৫ সালের পর কয়েক বছর তিনি কোনো চলচ্চিত্রে অভিনয় না করলেও, তিনি ভারতীয় ভোক্তা জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে নতুন পথ খুঁজে বের করেছেন। তিনি কিডজানিয়া ইন্ডিয়ার উল্লেখযোগ্য অংশের মালিক, মিরক্যাট ও মিরআর প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ করেছেন। স্ত্রী গৌরী খান রেড চিলিজসহ বিভিন্ন উদ্যোগে বিনিয়োগ করছেন।
খান অনুমোদনের দিকেও সবচেয়ে প্রিয় মুখ। তার পরিবারের উপস্থিতি কো-ওয়ার্কিং স্পেস, আর্থিক পরিষেবা এবং প্রায় তিন ডজন পণ্যে রয়েছে। এই পণ্যগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই ইসরায়েলি কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় সংস্থার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, যেমন হুন্ডাই ও কাস্ট্রোল অয়েল।
শাহরুখ খান শুধুমাত্র অভিনেতা বা ব্র্যান্ড নয়, বরং একটি সাম্রাজ্য। তিনি বিভিন্ন জনহিতকর কাজেও জড়িত, যেমন শিশু শিক্ষা, শিশু যত্ন, এবং আহতদের সহায়তা। ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস মন্তব্য করেছে, ‘তাকে ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের ওয়ারেন বাফেট বলা সম্পূর্ণ ভুল হবে না।’
তবে ২০২৫ সালে তার কোটিপতি হওয়ার সময় ভারতীয় মুসলিমরা সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি। মোদির শাসনামলে মুসলিমদের প্রান্তিকীকরণ, হত্যাকাণ্ড, নাগরিকত্ব হুমকি এবং বিচার বিভাগের পক্ষপাত লক্ষ্য করা গেছে। কাশ্মীরে ইসরায়েলি কৌশল অনুযায়ী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা হচ্ছে। সেই সময়ে খানের নীরবতা আরও গভীর।
গাজায় গণহত্যার সময় শাহরুখ খান কোনো প্রকাশ্য অবস্থান নেননি। পশ্চিমা বিশ্বে বিক্ষোভের সময় তিনি মেট গালায় উপস্থিত হন, যা তার নীরবতা নিয়ে নতুন প্রশ্ন তৈরি করে। প্রধানমন্ত্রী মোদির জন্মদিনে তিনি শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। অক্টোবরের মধ্যেই তিনি সৌদি আরবে আনন্দ উৎসবে উপস্থিত ছিলেন। বলিউডের তিন খান – শাহরুখ, সালমান ও আমির – সৌদি রাজপরিবারের সামনে তাদের চলচ্চিত্রের জন্য অর্থায়ন প্রদর্শন করেছেন।
অস্থিরতা, মৃত্যু ও ধ্বংসের এই সময়ে শাহরুখ খানের সম্পদের বৃদ্ধি এবং তার নীরবতা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, তার সাফল্য একটি সম্মতির উপর ভিত্তি করে, যা তাকে বলিউড ও আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে অনন্যভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে এটি সাধারণ মানুষের জন্য নয়, কেননা তিনি গাজা হামলা ও কাশ্মির কাণ্ডে নিরব ভূমিকা পালন করেছেন।

