কলাগাছের প্রায় প্রতিটি অংশই কোনো না কোনোভাবে খাওয়া যায়। সুস্বাস্থ্যের জন্য কাঁচকলা যেমন উপকারী, সবজি হিসেবে তেমনি উপকারী কলার মোচা বা কলার ফুল। কলা গাছের ঘনক আকৃতির পেচানো ফুলসহ কাণ্ডকে বলা হয় কলার মোচা। বারমাসী এই সবজি যেমন উপকারী তেমনি সুস্বাদুও।
কলার মোচা (বা কলা ফুল) একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর ও উপকারী সবজি যা আমাদের খাদ্যতালিকায় অনেকসময় উপেক্ষিত থেকে যায়। এটি শুধুমাত্র সুস্বাদুই নয়, বরং নানা স্বাস্থ্য উপকারিতা ও পুষ্টিগুণেও সমৃদ্ধ।
কলার মোচার পুষ্টিগুণ
ফাইবার বা আঁশ- হজমের জন্য খুব উপকারী। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। দীর্ঘ সময় পেট ভরা অনুভব হয়, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
প্রোটিন- নিরামিষভোজীদের জন্য ভালো প্রোটিন উৎস। দেহের কোষ গঠন ও রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
আয়রন (লোহা)- রক্তশূন্যতা (অ্যানিমিয়া) প্রতিরোধে কার্যকর। বিশেষ করে মহিলাদের জন্য উপকারী যাদের মাসিক চক্রে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়।
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট- দেহে ফ্রি র্যাডিক্যাল কমায়, যা বার্ধক্য প্রতিরোধে সহায়ক। ক্যানসার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে।
ভিটামিন সি ও ই- ত্বক ও ইমিউন সিস্টেমের জন্য উপকারি। প্রদাহ কমায় এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
কম ক্যালোরি ও কম চর্বি- ডায়েট অনুসরণকারীদের জন্য উপযুক্ত।
কলার মোচা শুধু পুষ্টিকরই নয়, বরং এটি একটি ভেষজগুণসম্পন্ন খাদ্য উপাদান হিসেবেও পরিচিত।
কলার মোচার উপকারিতা
রক্তশূন্যতা (অ্যানিমিয়া) প্রতিরোধে সহায়ক- কলার মোচায় আয়রনের পরিমাণ বেশি থাকে, যা হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সাহায্য করে। নিয়মিত খেলে রক্তের পরিমাণ বাড়ে ও দুর্বলতা কমে।
মাসিকের সময় ব্যথা ও অতিরিক্ত রক্তপাত নিয়ন্ত্রণ- নারীদের ঋতুচক্রের সময় হরমোন ভারসাম্য রক্ষা করে এবং ব্যথা ও অতিরিক্ত রক্তপাত কমাতে সাহায্য করে। এটি প্রাকৃতিক "হরমোন ব্যালেন্সার" হিসেবে কাজ করে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে- কলার মোচায় গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম থাকে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এটি ইনসুলিন সংবেদনশীলতাও বাড়াতে পারে।
হজম শক্তি বাড়ায় ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে- মোচায় প্রচুর আঁশ (ফাইবার) থাকে, যা পাচনতন্ত্র পরিষ্কার রাখে ও পেট পরিষ্কার করতে সাহায্য করে।
ওজন কমাতে সহায়ক- কম ক্যালোরি ও উচ্চ আঁশযুক্ত হওয়ায় এটি দীর্ঘক্ষণ পেট ভর্তি রাখে। অতিরিক্ত খাওয়া কমায়, ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ইমিউন সিস্টেম (রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা) বাড়ায়- অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন C ও অন্যান্য উপাদান রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে শরীরকে ইনফেকশন থেকে রক্ষা করে।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়- মোচায় থাকা ম্যাগনেশিয়াম ও পটাশিয়াম রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখে, যা হৃদরোগ প্রতিরোধে কার্যকর।
ত্বক ও চুলের জন্য উপকারি- ভিটামিন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকার কারণে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং চুল পড়া কমাতে সাহায্য করে।
গর্ভাবস্থায় কলার মোচা খাওয়া মা ও গর্ভস্থ শিশুর উভয়ের জন্যই বিশেষ উপকারি হতে পারে। এটি পুষ্টিকর, সহজপাচ্য এবং অনেক স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
গর্ভাবস্থায় কলার মোচা খাওয়ার উপকারিতা
রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে সহায়ক-গর্ভাবস্থায় অনেক নারীর শরীরে আয়রনের ঘাটতি দেখা দেয়, যার ফলে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা হয়। কলার মোচায় রয়েছে উচ্চমাত্রার আয়রন ও কপার, যা হিমোগ্লোবিন তৈরি করে এবং রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে সহায়ক।
হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখে- গর্ভাবস্থায় হরমোনের ওঠানামা নানা অস্বস্তির কারণ হয়। কলার মোচা প্রাকৃতিকভাবে হরমোন ব্যালান্স করতে সাহায্য করে, যা মানসিক চাপ, ক্লান্তি ও মেজাজ খারাপ কমাতে ভূমিকা রাখে।
বমিভাব ও হজমের সমস্যা দূর করে- এতে থাকা ফাইবার হজম শক্তি বাড়ায় ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। বমিভাব কমায় ও ক্ষুধা বাড়ায়, যা প্রেগন্যান্সিতে খুব প্রয়োজনীয়।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে- কলার মোচার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ায় এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে, বিশেষ করে যারা গর্ভাবস্থায় জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসে ভুগছেন।
ইমিউন সিস্টেম মজবুত করে- এতে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন C ও E যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে ভাইরাস ও ইনফেকশন প্রতিরোধে সাহায্য করে।
মূত্রনালির সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক- গর্ভাবস্থায় ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন সাধারণ সমস্যা। কলার মোচা এই সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে।
ভ্রূণের স্নায়ুতন্ত্র গঠনে সহায়ক- কলার মোচায় ফোলেট থাকে, যা শিশুর ব্রেন ও স্পাইনাল কর্ডের সঠিক গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
কলার মোচা পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং স্বাস্থ্যকর হলেও এর কিছু অপকারিতা আছে।
কলার মোচার অপকারিতা
গ্যাস ও অম্বলের সমস্যা: কলার মোচা ফাইবারে সমৃদ্ধ, তবে অনেকের জন্য এটি অতিরিক্ত গ্যাস বা অম্বল (অ্যাসিডিটি) সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে কাঁচা বা অপর্যাপ্তভাবে রান্না করলে।
হজমে সমস্যা: কারও কারও জন্য এটি হজমে একটু ভারী হতে পারে, বিশেষ করে যাদের হজমশক্তি দুর্বল বা যারা বেশি আঁশ খেলে পেট ফাঁপা হয়।
রক্তচাপ হ্রাস করতে পারে: কলার মোচায় পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম থাকে, যা রক্তচাপ কমায়। কিন্তু যাদের আগে থেকেই রক্তচাপ কম থাকে, তাদের ক্ষেত্রে এটি মাথা ঘোরা বা দুর্বলতা সৃষ্টি করতে পারে।
অতিরিক্ত খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য: আঁশযুক্ত হলেও পর্যাপ্ত পানি না খেলে বেশি পরিমাণ মোচা খাওয়ার ফলে উল্টো কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
অ্যালার্জি বা সংবেদনশীলতা: খুব কম হলেও কারও কারও দেহে কলার মোচার প্রতি অ্যালার্জি থাকতে পারে। যেমন: ত্বকে চুলকানি, ফুসকুড়ি বা হালকা ফোলা।
গর্ভাবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত গ্রহণে সমস্যা: যদিও গর্ভাবস্থায় এটি উপকারী, তবে অতিরিক্ত খেলে পেটে ভার বা হজম সমস্যা হতে পারে। তাই পরিমিত মাত্রায় খাওয়াই ভালো।