ঢাকা সোমবার, ০৯ জুন, ২০২৫

ইসলামে কি গণতন্ত্র জায়েজ?

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: জুন ৯, ২০২৫, ০২:২৭ পিএম

গণতন্ত্র (Democracy) আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম জনপ্রিয় শাসনপ্রণালী। এ ব্যবস্থায় জনগণই শাসক নির্বাচন করে, নীতিনির্ধারণে অংশ নেয় এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব তাদের ইচ্ছা ও মতের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইসলামে কি গণতন্ত্রের স্থান আছে? এটি কি শরিয়তসম্মত একটি পদ্ধতি, না কি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক?

প্রশ্নটি বহুবার বহু প্রেক্ষাপটে উত্থাপিত হয়েছে। কেউ একে ইসলামের মৌল চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মেনে নেন, আবার কেউ বলেন—গণতন্ত্র মূলত মানুষের ইচ্ছাকেই চূড়ান্ত কর্তৃত্বে বসায়, যা তাওহিদি দর্শনের বিরোধী। তাই বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন—ইসলামের মূলনীতিগুলোর আলোকে।

গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও মূলনীতি

গণতন্ত্র এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠিত হয় এবং আইন প্রণয়ন হয়। এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো- জনগণের কর্তৃত্ব (Sovereignty of the people), মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে শাসন, সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং ন্যায়বিচার ও নাগরিক অধিকার রক্ষা।

ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তায় কর্তৃত্ব কার?

ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব আল্লাহর। কুরআন বলছে- ‘সাবধান! সৃষ্টি এবং হুকুম আল্লাহরই।’— (সূরা আর-আরাফ: ৫৪)

অর্থাৎ ইসলামে আইন প্রণয়নের চূড়ান্ত অধিকার একমাত্র আল্লাহর। রাসুল (সা.) ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত আইনবিধান বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাসুল ও শাসক। সাহাবিরা তাঁর অনুপস্থিতিতে বা ইন্তেকালের পর ‘শূরা’ বা পরামর্শের ভিত্তিতে খলিফা নির্বাচন করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় জনগণের মত ও অংশগ্রহণ ছিল, যদিও তা সরাসরি ‘গণভোট’ ছিল না।

শূরা ও গণতন্ত্রের সাদৃশ্য

কুরআনে আল্লাহ বলেন- ‘...তাদের কাজ-কর্ম হয় পারস্পরিক পরামর্শে।’— (সূরা আশ-শূরা: ৩৮)

এই আয়াতের ভিত্তিতে ‘শূরা’ ব্যবস্থাকে ইসলামী রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি বলা হয়। এতে শাসনব্যবস্থায় পরামর্শ ও মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নবিজি (সা.) নিজেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন (যেমন- বদর, ওহুদ, হুদায়বিয়ার সন্ধি)। এখান থেকেই বোঝা যায়, জনগণের মতামতের মূল্য রয়েছে।

আধুনিক গণতন্ত্রে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন এবং আইন প্রণয়নের জন্য তাদের ক্ষমতা প্রদান একধরনের ‘সামাজিক চুক্তি’ বা ‘বাইআত’-এর মতো। কাজেই গণতন্ত্রের মধ্যে কিছু মৌলিক কাঠামো ইসলামী ব্যবস্থার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

তবে কি গণতন্ত্র পুরোপুরি ইসলামী?

এই জায়গায় মতপার্থক্য তৈরি হয়। কিছু ইসলামপন্থি পণ্ডিত যেমন—মওদুদী, হাসান আল-বান্না ও ইউসুফ আল-কারযাভি বলেছেন—ইসলামে এমন এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বৈধ, যা কুরআন ও সুন্নাহর সীমার মধ্যে থেকে চলে। একে বলা হয় ‘শূরাভিত্তিক গণতন্ত্র’ বা ‘ইসলামি গণতন্ত্র’।

তবে মৌলিক পার্থক্য হলো- গণতন্ত্রে আইনের উৎস জনগণ বা পার্লামেন্ট; ইসলামে আইনের উৎস কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা। অর্থাৎ গণতন্ত্র তখনই ইসলামসম্মত, যখন তা ইসলামের মৌলনীতি অতিক্রম না করে।

ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ গণতান্ত্রিক দিকসমূহ

১. মনগড়া আইন প্রণয়ন : যদি গণতান্ত্রিক সরকার এমন আইন প্রণয়ন করে, যা কুরআন-সুন্নাহর পরিপন্থি—তবে তা হারাম ও বাতিল।

২. সার্বভৌমত্বের বিকৃতি : গণতন্ত্রে মানুষই চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ, যা তাওহিদের পরিপন্থি হতে পারে, যদি আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ মানবকেন্দ্রিক আইন চালু হয়।

৩. আবেগনির্ভর সংখ্যাগরিষ্ঠতা : গণতন্ত্রে অনেক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভুল সিদ্ধান্তও আইন হিসেবে কার্যকর হয়, যা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন, মদ বা সুদের বৈধতা, সমলিঙ্গ বিবাহ—যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

ইসলামি ভাবধারায় গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক রূপরেখা

একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা ইসলামি হবে তখনই, যখন সেখানে—সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব থাকবে আল্লাহর বিধানে, শাসক নির্বাচিত হবে জনগণের মতামতে, শূরাভিত্তিক পরামর্শ থাকবে, অন্য ধর্ম ও মতামতের প্রতি সহনশীলতা থাকবে, বিচারব্যবস্থা স্বাধীন ও ন্যায়ভিত্তিক হবে, সরকার আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতার বিশ্বাস রাখবে।

এই কাঠামোতে গণতন্ত্রকে ব্যবহার করা যেতে পারে ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনায়, যেটা ‘ইসলামি গণতন্ত্র’ নামে পরিচিত।

খুলাফায়ে রাশেদিন যুগে (আবু বকর, উমর, উসমান, আলী রা.) প্রত্যেকেই পরামর্শ ও জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নেতৃত্বে আসেন।

নবিজি (সা.) কখনো রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলন করেননি। অনেক ইসলামি পণ্ডিত এই সময়কেই ‘মডেল ইসলামি গণতন্ত্র’ হিসেবে দেখেন।

ইসলামে গণতন্ত্র পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়, যদি তা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে বা কুরআন-সুন্নাহর বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করে। তবে ইসলামের মূলনীতি অনুযায়ী পরিচালিত একটি শূরাভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক ও জনগণের মতামতভিত্তিক শাসনব্যবস্থা—আসলে গণতন্ত্রের প্রকৃত সৌন্দর্যকেই ধারণ করে।

তাই বলা যায়, ইসলামে এমন এক ধরনের গণতন্ত্র জায়েজ—যা শরিয়তের সীমারেখায় পরিচালিত হয়, মানুষের মঙ্গলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় এবং আল্লাহর বিধানকে অগ্রাধিকার দেয়। এই ব্যালান্সটিই আজকের মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—শাসনে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ থাকলেও যেন তা হয় ইসলামি মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্ত।

আধুনিক ব্যবস্থায় ইসলামি চেতনার প্রতিফলন—সেটিই হওয়া উচিত প্রকৃত মুসলিম গণতন্ত্রের লক্ষ্য।