বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মুশফিকুর রহমান বাদল

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৭, ২০২৫, ০৪:২২ পিএম

ইচ্ছের মৃত্যু

মুশফিকুর রহমান বাদল

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৭, ২০২৫, ০৪:২২ পিএম

ইচ্ছের মৃত্যু

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

পরীক্ষার হলে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায় জুঁই। সহপাঠীরা তড়িঘড়ি করে ওকে ধরে ফেলে। শিক্ষকরাও ছুটে আসেন জুঁইয়ের কাছে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। রিকশা ডেকে এনে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় সহপাঠীরা। অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা আর দেওয়া হলো না জুঁইয়ের।
ডাক্তার জ্বর কমানোর ওষুধ দিয়ে ব্লাড টেস্ট, ইউরিন টেস্ট ও আল্ট্রাসাউন্ড করতে বলে বাসায় পাঠিয়ে দেন।
জুঁইয়ের এমন শারীরিক অবস্থা দেখে ওর মা, ভাইয়েরা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। জুঁই সবাইকে কাঁদতে নিষেধ করে একটু ঘুমাতে চায়। ডাক্তারের কাছে নেওয়ার পথে কয়েকবার বমি করে দুর্বল হয়ে পড়েছে সে।
জুঁইয়ের মা জাকিয়া বেগম মেয়ের এমন অবস্থা দেখে কেঁদে-কেটে একাকার। চোখের পানি মুছছে আর মেয়ের মাথায় পানি ঢালছে। রাতটা কেমনে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে পাড়ি দেবে এই টেনশনও মাথায় ঘুরছে। হঠাৎ এমন গা-কাঁপানো জ্বর কেন এলো, এই চিন্তাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। জাকিয়া বেগম অনেক আগে এক ডাক্তারের কাছে শুনেছিলেন জ্বর হলো অন্য রোগের প্রাথমিক উপসর্গ। কঠিন কোনো ব্যাধি হয়নি তো মেয়েটার। মায়ের মনটা নানা দুশ্চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আর আল্লাহকে ডেকে বলছে, ‘আল্লাহ, আমার মেয়েকে বড় কোনো কঠিন রোগ দিও না। ওকে তুমি সুস্থ করে দাও। দ্রুত শেফা দান কর। মেয়েটা যেন পরীক্ষা দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে।’
সারারাত জ্বরের মধ্যেই ঘুমিয়েছে জুঁই। সকাল হয়ে গেছে। বারান্দায় জুঁইয়ের নিজ হাতে লাগানো গাছগুলোয় সূর্যের আলো এসে পড়েছে। কয়েকটা টবে বেলী ফুটেছে। অ্যালোভেরা গাছগুলোও তরতর করে বেড়ে উঠছে তলোয়ারের মতো। প্রতিদিন সকাল-বিকেল গাছগুলোর যত্ন নেওয়া জুঁইয়ের নেশা। কলেজ ছুটির পর বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়ে নতুন গাছের খোঁজ নেওয়া, গাছের জন্য মাটি-সার জোগাড় করে বাসায় আনাও তার অন্যতম শখ। জুঁই বিছানা থেকে উঠে জ্বর নিয়েই গাছগুলোতে হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়। বেলীফুলের গাছে হাত বুলাতেই কয়েকটি সাদা ধবধবে বেলী টুপ করে ঝরে পড়ে। আগে এমনটা কখনো হয়নি। জেরিন বিষয়টা খেয়াল করে। ওর মনের মধ্যে কেমন একটা তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। তবে কি জুঁইও টুপ করে ঝরে পড়বে পৃথিবী নামক বৃক্ষ থেকে? না, আর ভাবতে পারে না জুঁই। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে বেলীফুল গাছের সবুজ পাতায়।
জাকিয়া বেগম দূর থেকে সবকিছু দেখছিলেন। হাসিখুশি চঞ্চল মেয়েটা হঠাৎ একদিনেই কেমন বদলে গেছে। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা মনে হতেই নিজের অজান্তে ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
জ্যৈষ্ঠের ভ্যাপসা গরম। অনেক দিন ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। বলা চলে চারদিকে বৃষ্টির জন্য হাহাকার চলছে। জুঁই বৃষ্টি খুব ভালোবাসে। শিশুকাল থেকেই সে বৃষ্টি নামলে ঘর থেকে বেরিয়ে মনের আনন্দে ভিজবে। বৃষ্টিতে ভেজার জন্য কখনো তাকে বকাও খেতে হয়নি। বৃষ্টিতে ভিজলে অনেকের জ্বরজারি হয়। জুঁইয়ের তাও কখনো হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় হলেও বৃষ্টির প্রতি প্রেম তার এতটুকুও কমেনি; বরং আরও বেড়েছে। এবারের বর্ষায় শুধু বৃষ্টিতে ভেজার জন্য গ্রামের নানুবাড়ি যাওয়ার কথা। জুঁইয়ের জন্ম নানাবাড়িতে ২০ বছর আগে আষাঢ় মাসের এক প্রবল বর্ষণমুখর দিনে। আজও বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে না। বিকেলে জুঁইকে নিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হবে ব্লাড টেস্ট, চেস্ট এক্সরে, হোল এবডোমিন আলট্রাসাউন্ড করার জন্য।
জুঁইয়ের জ্বর সকালের পর থেকে একটু কম মনে হচ্ছে। তবে অতিরিক্ত বমি হওয়ার কারণে শরীর বেশ দুর্বল। তারপরও বই পড়ার নেশায় বই নিয়েই পড়ে থাকে সে। শুয়ে শুয়েই পরবর্তী পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে চলছে। সাধারণত কারো শরীর ভালো না থাকলে মনও ভালো থাকে না। কিন্তু জুঁই একটু অন্য ধাঁচের মেয়ে। যেমন পড়াশোনায় ভালো, সকল সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে তার সপ্রতিভ সপ্রশংসনীয় অংশগ্রহণের কারণে পুরো ক্যাম্পাসে সে প্রিয়মুখ। চাটগাঁয়ের মেয়ে হিসেবে ওর মধ্যে সাহসটা মনে হয় প্রকৃতিগতভাবেই এসেছে। ওর মেধা আর সাহসের কারণে ওকে অনেকে প্রীতিলতা বলে ডাকে। ওর মুখাবয়বে নাকি প্রীতিলতার একটা ছায়া আছে। হয়তো বা আছেও। হয়তো বা নেই। এ নিয়ে জুঁইয়ের কোনো ভাবনাও নেই। ও ওর সক্রিয়তা নিয়েই পথ চলছে। অথচ এই সাহসী মেয়েটা একটা অজানা রোগে ভুগছে। আজ হয়তো কিছু টেস্ট করলে কিছুটা জানা যাবে। বিকেলেই যাবে টেস্ট করাতে।
মাকে নিয়ে বিকেলেই শহরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চলে যায় জুঁই। এই টেস্ট সেই টেস্ট দিয়ে চলে আসে বাসায়। সকালে সব রিপোর্ট পাওয়া যাবে বলে ওখান থেকে জানানো হয়। কিন্তু মা-মেয়ের দুজনের মনের মধ্যেই একটা অজানা আশঙ্কা, অচেনা ভয় কাজ করছে। জটিল কোনো রোগ হয়নি তো?
আজ বৌদ্ধ পূর্ণিমার রাত। আকাশে কয়েক টুকরো জলহীন মেঘ ঘোরাঘুরি করছে। কিন্তু চাঁদকে ঢেকে দেওয়ার মতো সামর্থ্য পিচ্চি মেঘগুলোর নেই বললেই চলে। চাঁদও মেঘগুলোকে তেমন পাত্তাই দিচ্ছে না। পুরো আকাশে আজ যেন চাঁদেরই একক রাজত্ব, এক কর্তৃত্ব। চাঁদের আলোয় খাঁ খাঁ করছে সব। ধবধবে জ্যোৎস্না জুঁইয়ের জানালার কাচে, বাগানের টবের গাছে ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে যেন। জুঁই অন্যদিন রাতের বেলা জানালা বন্ধ রাখলেও আজ খোলা রেখেছে। চাঁদের আলোয় তার সারা শরীর যেন অবগাহন হচ্ছে। জ্যোৎস্না যেন তার মনের মধ্যে অন্যরকম এক মায়াবী আবহ তৈরি করেছে। মনে মনে জুঁই ভাবতে থাকে; ‘এমনি চাঁদের রাতে মরণ যদি হয় সেও ভালো, সে মরণ স্বর্গসম।’ বেলীর পাতা চাঁদের আলোয় একটু কালো দেখালেও বেলীফুলগুলো আরও বেশি ধবধবে সাদা দেখাচ্ছে, যেন চাঁদের সঙ্গে তার সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা চলছে। জুঁই বারান্দায় গিয়ে বেলীগুলোকে একটু ছুঁয়ে দেখতে যাবে তখনই সকালের ঘটনা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। না থাক, রাতে আর টবের কাছে যাবে না; বরং চাঁদের সঙ্গে তাদের মিতালি, কথোপকথন দেখেই রাতটা পার করে দেবে।
গতকাল বিকেলে সব রিপোর্ট হাতে পেয়েছে। মনে যে ভয় বাসা বেঁধে ছিল, রিপোর্টও তাই বলছে। জুঁইয়ের দেহে ব্লাড ক্যানসারের সেল পাওয়া গেছে। আরও কনফার্ম হওয়ার জন্য ঢাকা থেকে ফুসফুসের বায়োপসি, এমআরআই এসব করার নির্দেশনা দেওয়া আছে।
এমন একটা কঠিন ব্যাধির কথা জানলে কারো মন ভালো থাকার কথা নয়। মা-মেয়ের মনের অবস্থাও ভীষণ খারাপ। জুঁইয়ের কাছে মা-ই সব। বাবা যেন থেকেও নেই। সংসারের প্রতি, সন্তানের প্রতি দায় এড়িয়ে চলছে অনেক বছর আগে থেকেই। এরপর থেকে মা-ই সংসারের সব। জুঁই মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, বেশি ভেব না মা, ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। তুমি ভেঙে পড়লে আমি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ব।
বিকেলেই জুঁইকে নিয়ে জাকিয়া বেগম ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। রাতে ঢাকা পৌঁছে এক আত্মীয়ের বাসায় রাত কাটিয়ে সকালেই এমআরআই, বায়োপসি করতে হাসপাতালে চলে আসেন। সকাল সকালই সব টেস্ট শেষ হয়ে যায়। পরেরদিন সন্ধ্যায় হেমাটো অনকোলজি ডাক্তারের এপয়েনমেন্ট নেওয়া আছে। ডাক্তার রোগের ইতিহাস শুনে, সব রিপোর্ট দেখে দ্রুত কেমোথেরাপি শুরু করতে হবে বলে জানান। কারণ ক্যানসার চতুর্থ ধাপে এখন। এখান থেকে রোগীকে রিকোভারি করা কষ্টকর। রাতেই কেমোথেরাপির প্রথম ডোজ শুরু করে দেওয়া হয়। জাকিয়া বেগম একমাত্র মেয়ের প্রাণভিক্ষা চেয়ে মনে মনে আল্লাহকে ডেকে চলেছেন। সাতদিন পরপর ছয়টা কেমো নিতে হবে। এরপর রোগীর অবস্থা বুঝে রেডিওথেরাপির কথা ভাববেন ডাক্তার। কিন্তু দুইটা কেমোথেরাপি দেওয়ার পর জুঁইয়ের শারীরিক অবস্থা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে যায়। দ্রুত আইসিইউতে নেওয়া হয় তাকে। বোঝা যাচ্ছে জুঁই চিকিৎসার ঊর্ধ্বে চলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। জাকিয়া বেগম আইসিইউ কক্ষের বাইরে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দুই পা লম্বা করে ছড়িয়ে নির্বাক বসে আছেন। তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
আষাঢ় শুরু হয়েছে।  জ্যৈষ্ঠ মাসে বৃষ্টি না হলে এখন প্রায়ই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আজও সন্ধ্যা থেকে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হচ্ছে। এই আষাঢ়েই জুঁইয়ের জন্ম। এবার কদম আর কৃষ্ণচূড়া ফুল দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে বর্ষা উদযাপন ও জন্মদিন পালন করবে বলে আগেই বন্ধুদের বলে রেখেছিল। কিন্তু আষাঢ় আছে, ঝুমবৃষ্টি আছে ঠিকই কিন্তু, বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে বর্ষাবরণ করার ইচ্ছে ছিল যার, আজকের বৃষ্টিমুখর রাতে তার ইচ্ছেদের ছুটি হলো মৃত্যুর হিমশীতলতায়। তার সহপাঠী বন্ধু ও শিক্ষকরা কবরের পাশে রোপণ করে দিয়েছেন একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। সে গাছে তার ইচ্ছেগুলো থোকা থোকা হয়ে ফুটে থাকবে প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে।

 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!