ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই, ২০২৫

প্রকৃতির কোলে স্বর্গীয় অনুভব : একদিনের খৈয়াছড়া ভ্রমণ

রাব্বি মিয়া
প্রকাশিত: জুলাই ৩, ২০২৫, ০৯:২২ পিএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

ঘড়ির কাঁটা যখন রাত ১২:৩০ ছুঁই ছুঁই, তখন আমি আর তানিম মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল স্টেশন থেকে ধীরে ধীরে গতি নিতে থাকা ট্রেনে উঠে পড়ি। গন্তব্য—ফেনী। জানালার বাইরে ভেসে চলা চা-বাগানের বাতাস, কুয়াশায় মোড়া সবুজ পথ আর ছায়াময় বনভূমি যেন আগেই আমাদের খৈয়াছড়ার পথে নিয়ে যেতে চাইছিল। মনে হচ্ছিল, সামনে অপেক্ষা করছে এক দারুণ অ্যাডভেঞ্চার।

ফেনী স্টেশনে পৌঁছাই ভোর ৫টার দিকে। ফজরের নামাজ আদায় করে রিকশায় যাই মহিপাল বাসস্ট্যান্ড। ঢাকা থেকে আসা নুরুল ভাই, লিখন ভাই, নাসিফ ভাই, ভাবি ও ফেনীর আরিফ ভাই আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। সকালের নাস্তা সেরে বাসে উঠি মীরসরাইয়ের দিকে। 

৪০ মিনিট পর বড়তাকিয়া বাজারের আগে খৈয়াছড়া স্কুলের কাছে নেমে সিএনজি করে রওনা হই স্বপ্নের গন্তব্যের দিকে—খৈয়াছড়া ঝর্ণা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও মনোমুগ্ধকর জলপ্রপাতগুলোর একটি এটি। শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে সবুজের আলিঙ্গনে হারিয়ে যাওয়ার এক তীব্র ইচ্ছা নিয়ে পৌঁছাই খৈয়াছড়ার প্রবেশপথে।

খৈয়াছড়ায় পা রাখতেই পাহাড়ি বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। পাখির গান আর সবুজে ঘেরা চারপাশের নীরবতা এনে দেয় এক পবিত্র অনুভূতি। সিএনজি থেকে নেমেই ঝিরিপথে হাঁটা শুরু করি। পথটি সহজ নয়—পাথুরে, আঁকাবাঁকা, কোথাও পিচ্ছিল কাদা, কোথাও ঠান্ডা জল। ছোট ছোট ঝর্ণার ধারা পেরিয়ে যেতে হয় ৯টি ধাপে, প্রতিটি ধাপে এক নতুন সৌন্দর্য অবাক করে। এ কারণেই একে বাংলাদেশের ‘ঝর্ণার রানী’ বলা হয়।

ভেতরে ঢোকার আগে দোকানগুলোতে ব্যাগ জমা রেখে খাবারের অর্ডার দিয়ে রাখি। বাঁশের লাঠি ও স্লিপার কিনি যাতে পিচ্ছিল পথে সহজে চলা যায়। এগুলোই আমাদের কঠিন ট্রেকিংয়ের সহায় হয়েছে।

আমি বিশাল শেওলাধরা পাথরে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করি। পেছনে সবুজ পাহাড়, নিচে শান্ত জল, আর চোখের সামনে ঝর্ণার নেমে আসা জলরাশি—সবকিছু মিলিয়ে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। ঝর্ণার স্বচ্ছ, শীতল জলে হাত ছোঁয়াতেই ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।

ঝর্ণার প্রথম ধাপ পার হওয়ার পর শুরু হয় আসল পরীক্ষা। লাঠি ধরেই নয়, রশি ধরে খাড়া পাথর বেয়ে উঠতে হয়েছে। নিচে তাকালেই ভয়, কিন্তু ঝর্ণার সাদা ফেনার মতো জলধারা আর শীতল বাতাস ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছিল। ভাবি দারুণ সাহসিকতা দেখিয়েছেন, যা আমাকেও অনুপ্রাণিত করেছে।

চূড়ায় পৌঁছে পেশী বিদ্রোহ করছিল, তবুও এ জয় ছিল আনন্দের। ঝর্ণার শীতল জলে স্নান করি, ছবিতে বন্দি করি মুহূর্তগুলো। নামার পথও চ্যালেঞ্জিং ছিল, তবে পথের কলা ও লেবুর শরবত ছিল অমৃতের মতো। ক্লান্তিতে নিচে ফিরে কিছুক্ষণ শুয়েই থাকতে হয়েছিল।

হোটেলে ফিরে স্নান করে তৃপ্তি নিয়ে দুপুরের খাবার খাই। খাবারের মান ও আতিথেয়তা ছিল অসাধারণ। বিশ্রাম শেষে দুপুর ২টায় বের হই পরবর্তী গন্তব্য বাওয়াছড়া লেকের উদ্দেশে। লেকের স্বচ্ছ জলে নৌকা ভ্রমণ ছিল প্রশান্তির। সবুজ পাহাড়ের মাঝে নৌকা ভাসিয়ে সূর্যাস্তের আলোয় সৌন্দর্য উপভোগ করি।

শেষ রাতে আরিফ ভাইয়ের বাসায় থেকে পরদিন সকালে শ্রীমঙ্গলে ফিরে আসি। এক দিনের এই খৈয়াছড়া ভ্রমণ আমার স্মৃতিতে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার এই অভিজ্ঞতা অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য নিঃসন্দেহে উপযোগী। খৈয়াছড়ার অপার সৌন্দর্য একবার দেখলে বারবার টানে, যা সংরক্ষণ করা আমাদের সবার দায়িত্ব।

রাব্বি মিয়া এসইও এক্সপার্ট, সংবাদকর্মী ও ভ্রুমণ পিপাসু