পাঁচ বছর আগে মেঘলা ও রিমন ভালোবেসে শুরু করেছিলেন সংসার। একটি ৩ বছরের কন্যাসন্তান নিয়ে ভালোসার সংসার ভালোই চলছিল মেঘলা-রিমন দম্পতির। হঠাৎ চাকরি হারান রিমন। এরপর থেকে তাদের সংসারে শুরু হয় নানা জটিলতা। রিমনকে অপছন্দ করতে শুরু করেন মেঘলা।
রিমনের চাকরি চলে যাওয়ার পর আর্থিক দুরবস্থায় পড়ে সংসারটি। বিয়ের আগেই মেঘলা সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। সংসারের আর্থিক অনটন দূর করতে মেঘলা একদিন রিমনকে বলেন যে, তার বন্ধু বাঁধন তাকে নাভানা কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারে বলে জানিয়েছে। সংসারের আর্থিক উন্নতির জন্য রিমন মেঘলার প্রস্তাবে রাজি হন। এরপর মেঘলা সেই চাকরিতে যোগ দিয়ে জীবন পার করেন। এই সময়ে বন্ধু বাঁধনের সঙ্গে মেঘলার একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
অন্যদিকে, সাংসারিক নানা জটিলতাকে কেন্দ্র করে স্বামী রিমনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে মেঘলার। মেঘলা রিমনকে আর আগের মতো গ্রহণ করতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে দেড় বছরের মাথায় মেঘলা তার কন্যাসন্তানকে রেখে রিমনকে ডিভোর্স দিয়ে বাঁধনের সঙ্গে নতুন সংসার শুরু করেন। অনেক কষ্ট হলেও রিমন এখন তার কন্যাকে জড়িয়ে বাঁচতে চাইছেন।
গত মঙ্গলবার রূপালী বাংলাদেশকে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে এই কাহিনি জানিয়েছেন মেঘলার স্বামী রিমন। রিমন বলেন, ‘আমাদের ভালোবাসার সংসারের শেষ পরিণতি হলো ডিভোর্স। অনেক চেষ্টা করেছি মেঘলাকে ফিরিয়ে আনতে, বিনিময়ে নির্যাতনের মুখে পড়েছি। তারপরও বলব, মেঘলা তুমি ফিরে এসো।’
রিমন বলেন, ‘সম্প্রতি ফরিদপুরে জনসম্মুখে এক নারী তার স্বামীকে মারধর করার খবরে আমারও পুরোনো নির্যাতনের কথা মনে পড়ে। বর্তমান সমাজে আমরা পুরুষেরা অনেক নির্যাতিত।’
তিনি মনে করেন, সমাজে পুরুষের তুলনায় ডিভোর্সে নারীরাই এগিয়ে। আর পরকীয়ার কারণেই পারিবারিক সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলছে।
এ বিষয়ে জানতে মেঘলার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘রিমন খারাপ ছেলে। সে বিয়ের আগে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছিল। সে আমাকে বলেছিল, তাদের অনেক সম্পদ। তার বাবা টিঅ্যান্ডটির পরিচালক। বিয়ের পর সব কিছু জানতে পারি। আসলে তার বাবা টিঅ্যান্ডটির গার্ড, সে আমাকে মিথ্যা বলেছিল। তা ছাড়া ও চাকরি করত কেএফসিতে, আমাকে বলেছিল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। নানা বিষয়ে সে প্রতারণা করেছে। এ জন্য ডিভোর্স দিয়েছি।’
সন্তানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে মাঝে মাঝে মেয়েটাকে দেখে আসি এবং কাছে রাখি, এতে আমার বর্তমান স্বামীর কোনো বাধা নেই।’
পরকীয়ার কারণে স্বামী রাকিবকে ডিভোর্স দেন ময়না খাতুন। ময়না ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির ছাত্রী ছিলেন। রাকিব আর ময়না একসঙ্গে পড়াশোনা করতেন। পাশাপাশি রাকিব চাকরিও করতেন। পড়াশোনা করা অবস্থায়ই বিয়ে করেন রাকিব-ময়না। তাদের ভালোবাসার সংসার টিকেছিল মাত্র ৫ বছর। এর মধ্যেই একটি ছেলেসন্তানের জন্ম হয়। রাকিব ছাত্রজীবনে চাকরির পাশাপাশি ময়নাকে পড়ালেখার খরচও দিতেন। একদিন রাকিব ময়নাকে ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির এক শিক্ষকের সঙ্গে কাফরুলের একটি রেস্টুরেন্টে দেখেন। ময়না প্রায়ই ওই শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতেন।
এ বিষয়ে রাকিব বলেন, ‘আমি অপেক্ষায় থাকি, ময়না হয়তো আমাদের সন্তানকে নিয়ে একদিন ফিরে আসবে। সে আমার নামে মামলা করেছে, সেটা মুখ্য বিষয় নয়। একটি কথা বলতে চাই, আমি একজন পুরুষ হিসেবে ময়নার কারণে নির্যাতিত হচ্ছি।’
এমন গল্প শুধু রিমন ও রাকিবের গল্পই নয়। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনায় আমাদের সমাজে নারীরাই এগিয়ে রয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেড়ে যাওয়া ও তাতে নারীদের এগিয়ে থাকার বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিচ্ছেদের জন্য নারীরাই বেশি উদ্যোগী হচ্ছেন। এর কারণ হিসেবে তারা পারিবারিক সহিংসতা, দাম্পত্য কলহ, চাহিদা ও আকাক্সক্ষার পার্থক্য পরকীয়া, মাদকাসক্তি, অর্থনৈতিক সংকট এবং শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের সঙ্গে স্ত্রী বা স্বামীর সম্পর্কের অবনতি। বিবাহবিচ্ছেদের কারণ।
এ ছাড়া আগের তুলনায় শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে নারীদের স্বাবলম্বী হওয়াও অন্যতম কারণ বলে তাদের মত। তবে বিবাহবিচ্ছেদের এই প্রবণতা সমাজের জন্য উদ্বেগজনক বলে তারা মনে করেন।
বর্তমান সমাজে বিবাহবিচ্ছেদকে আগের মতো আর ‘সামাজিক ট্যাবু’ হিসেবে দেখা হয় না। মানুষ এখন তাদের ব্যক্তিগত সুখ এবং মানসিক শান্তির জন্য বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করে না। বিবাহবিচ্ছেদের এই প্রবণতা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে সন্তানরা মানসিক কষ্ট পায় এবং সমাজে অস্থিরতা বাড়ে। তাই, বিবাহবিচ্ছেদের কারণগুলো খুঁজে বের করে তা সামাজিকভাবে সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে পরামর্শ দেন বিশ্লেষকেরা।
পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীতে প্রতিবছর বিবাহবিচ্ছেদের হার বাড়ছে। ২০২৪ সালে শুধু রাজধানীতেই প্রতি মাসে ৬০৯টি ডিভোর্সের নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তথ্য অনুযায়ী এক শতাংশ ডিভোর্স দিচ্ছেন পুরুষ আর বাকি ৪ শতাংশ ডিভোর্সের নোটিশ দিচ্ছেন নারীরা।
২০২১ থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট ডিভোর্সের নোটিশ পাঠানো হয়েছে ৪৮ হাজার ৩৬৯টি। এর মধ্যে পুরুষের পাঠানো নোটিশের সংখ্যা ১২ হাজার ২৯৯ এবং নারীর পাঠানো নোটিশের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৭০টি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২০২১ সালে নারী কর্তৃক ডিভোর্সের নোটিশ পাঠানো হয়েছে ৫ হাজার ১১৩টি। আর পুরুষ পাঠিয়েছেন ২ হাজার ৬২টি নোটিশ। ২০২২ সালে নারী কর্তৃক পাঠানো হয়েছে ৫ হাজার ৩৮৩টি নোটিশ। পুরুষ পাঠিয়েছেন ২ হাজার ৩১৫টি। ২০২৩ সালে নারী কর্তৃক নোটিশ পাঠানো হয়েছে ৫ হাজার ২৮৭টি। পুরুষ পাঠিয়েছেন ২ হাজার ২০টি। ২০২৪ সালে নারী কর্তৃক পাঠানো হয়েছে ৫ হাজার ৭৬৪টি নোটিশ। পুরুষ পাঠিয়েছেন ১ হাজার ৫৪৮টি নোটিশ।
ডিভোর্সের হার কীভাবে কমানো যায় এমন প্রশ্নে বিশেষজ্ঞদের মত, সংসার এখন সমঅধিকার ও সমমর্যাদার স্থান। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক অনুশাসনেরও প্রয়োজন রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের (সাবেক) অধ্যাপক ড. শাহ এহসান হাবীব বলেন, ‘বর্তমানে সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনাচারণেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। ডিভোর্স বিষয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পাল্টেছে। আগে এটাকে কলঙ্ক হিসেবে দেখা হলেও এখন সেটাকে মেনে নিয়েছে সমাজ।’
ডিভোর্সের পরও যে আত্মনির্রশীল হয়ে বাঁচা যায়, নিজের সুখ ও আত্মসম্মানকে প্রাধান্য দিয়েও ভালো থাকা যায় এমন একটা ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। এ বিষয়গুলো ডিভোর্সের হার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মন্তব্য করেছেন এ সমাজবিজ্ঞানী।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, ‘মেয়েরা আগে ডিভোর্স দিতে পারত না, কারণ তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ছিল না। নির্যাতন সহ্য করে সংসার করে যেত। এখন নারীরা চিন্তা করছে, অন্যের ওপর নির্ভরশীল না থেকে ডিভোর্স দিয়ে আলাদা থাকাটাই ভালো।’
বিষয়টিকে ইতিবাচক উল্লেখ করে এ আনইনজীবী বলেন, ‘নারী-পুরুষ উভয়ই ভাবছে, একসাথে থেকে মারামারি-খুনোখুনি করে মামলা-মোকদ্দমায় না গড়িয়ে অলাদা হয়ে শান্তিতে থাকাটাই শ্রেয়।’
এক মনোবিজ্ঞানী নাম প্রকাশ না করে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘একে অপরকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলাম। যদিও বিয়ের পর আমাদের জীবন সুখেই যাচ্ছিল; কিন্তু বছর না ঘুরতেই দুজনের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়। তাই আলাদা হয়ে যাই।’
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী অধ্যাপক (মনোবিজ্ঞান বিভাগ ও কাউন্সেলিং সেন্টার) বিজন বাড়ৈ বলেন, ‘সম্পর্কের জটিলতায় বিচ্ছেদ, এ ছাড়া বিয়ের আগে ও পরের ভালোবাসার জটিলতায় বিচ্ছেদ বাড়ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বিচ্ছেদ কিংবা ডিভোর্সের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে, যেমন ঢাকায় ৩০ মিনিটে একটি তালাক হচ্ছে। এদের মধ্যে একটা বড় অংশের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের পরে বিয়ে হয়ে তারপর তালাক হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো নারী-পুরুষ দুজনে দুজনকে সময় নিয়ে জেনেশুনে কিংবা দীর্ঘদিনের একটা সম্পর্কের পরে বিয়ে করেছে, কিন্তু কী এমন হয় যে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরা শুরু করে। আমরা সামাজিকভাবে যদি এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করি, কী এমন ঘটতে পারে, যে কারণে ভালোবাসা ধীরে ধীরে বিষাদ কিংবা তিক্ততায় পরিণত হচ্ছে, তাহলে এসব নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’