ধোঁয়াশার আস্তরে ছেয়ে আছে দক্ষিণ মেক্সিকোর গভীর জঙ্গল। সময়ের আবরণ সরিয়ে যখন সূর্যরশ্মি চুম্বন করে পাথরের প্রাচীন পিরামিড; তখন সেখানে অতীতের এক গহীন গান প্রতিধ্বনিত হয়। ঘন পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা মায়া সভ্যতার চিহ্নগুলো মানুষকে নিয়ে যায় এমন এক জগতে, যেখানে জ্যোতির্বিজ্ঞান আর স্থাপত্য শিল্প হাত ধরাধরি করে রচনা করেছিল সভ্যতার এক বিস্ময়কর অধ্যায়। যতই এ অঞ্চলের গভীরে প্রবেশ করা যায়, ততই মনে হয় এখানে সময় থমকে আছে। প্রতিটি পাথরের ফাঁকে ফাঁকে জমে থাকা ইতিহাসের কাহিনি সবসময় অপেক্ষা করে নতুন অভিযাত্রীর স্পর্শের। এখানে আকাশের নীল আর জঙ্গলের সবুজের মাঝে দণ্ডায়মান মায়া সভ্যতার প্রাচীন স্মারকগুলো যেন সগৌরবে ঘোষণা করে, ‘রাজত্ব আজ আর না থাকলেও আমাদের গল্প অমর।’
গবেষকদের মতে মায়া সভ্যতা গড়ে উঠেছিল প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। মধ্য আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে, যা আজকের মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, বেলিজ, হন্ডুরাস এবং এল সালভাদর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এখানকার মানুষেরা কৃষিকাজের ওপর নির্ভর করে গড়ে তুলেছিল এক শক্তিশালী সমাজব্যবস্থা। মায়ারা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং গণনার অনন্য পদ্ধতির জন্য বিখ্যাত।
মায়া সভ্যতার অন্যতম চমকপ্রদ দিক তাদের স্থাপত্যশিল্প। চিচেন ইতজা এল ক্যাস্তিলো পিরামিড, টিকালের আকাশচুম্বী মন্দির, এবং প্যালেঙ্কের জটিল খোদাই করা স্মৃতিসৌধগুলো প্রমাণ করে তাদের স্থাপত্যশৈলী কতটা উন্নত ছিল। প্রতিটি পিরামিডের কাঠামোতে খোদাই করা হয়েছে দেবতা, গ্রহ এবং কালের অনুপ্রেরণামূলক প্রতীক।
মায়ারা জ্যোতির্বিজ্ঞানে ছিল অতুলনীয়। তারা সূর্য, চাঁদ এবং গ্রহগুলোর গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে তৈরি করেছিল অত্যন্ত সঠিক ক্যালেন্ডার। ২০১২ সাল নিয়ে মায়া ক্যালেন্ডার ঘিরে বিশ্বজুড়ে যে আলোড়ন হয়েছিল, তা হয়তো একধরনের ভুল ব্যাখ্যা ছিল; কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের গভীরতা মানুষকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে।
জানা যায়, মায়ারা প্রকৃতি পূজারি ছিল। তারা বিশ্বাস করত প্রতিটি প্রাকৃতিক উপাদান, যেমন- পাহাড়, নদী, আকাশ ইত্যাদি এক একটি জীবন্ত সত্তা। এ ছাড়া তাদের ধর্মীয় আচার এবং উৎসবগুলো ছিল জাঁকজমকপূর্ণ।
৯০০ খ্রিস্টাব্দের পর মায়া সভ্যতার পতনের সূচনা ঘটে। যুদ্ধ, পরিবেশগত সংকট এবং সামাজিক অস্থিরতা এই সভ্যতার অবলুপ্তির পেছনে ভূমিকা রেখেছিল। যদিও তাদের নগরগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত; তবে মায়া জনগোষ্ঠী এখনো মধ্য আমেরিকায় বসবাস করে এবং তাদের ঐতিহ্য বহন করে। আজকের দিনে মায়া সভ্যতার নিদর্শনগুলো পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। চিচেন ইৎজা, টিকাল, এবং কোবার ধ্বংসাবশেষ ঘুরে দেখার জন্য পর্যটকরা ভিড় জমায়। মায়াদের স্থাপত্যের মাঝে দাঁড়িয়ে যখন প্রকৃতির গভীরতার সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায়, তখন জীবন এবং কালের মহিমা নতুনভাবে উপলব্ধ হয়। মায়া সভ্যতার পাথরের শহরগুলো এখনো মাটির গভীরে লুকিয়ে রয়েছে কোনো নতুন অভিযাত্রীর অপেক্ষায়।
আপনিও হারিয়ে যান, যদি কখনো সময়ের এই মায়াজালে নিজেকে হারানোর সুযোগ পান!
আপনার মতামত লিখুন :