বিশ্ববাসীর অগোচরে পৃথিবীর অক্ষীয় ঘূর্ণনের গতি বেড়ে চলেছে। বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানে পৃথিবী তার স্বাভাবিক গতির তুলনায় কিছুটা দ্রুত ঘুরছে। ফলে প্রতিদিনের দৈর্ঘ্য মিলিসেকেন্ড (হাজার ভাগের এক সেকেন্ড) পরিমাণ কমে যাচ্ছে। যদিও এই পরিবর্তন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। তবে সময় গণনা এবং প্রযুক্তি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে।
দিনের দৈর্ঘ্য ২৪ ঘণ্টা নয়!
আমরা সাধারণভাবে জানি, এক দিন ২৪ ঘণ্টা বা ৮৬,৪০০ সেকেন্ডের সমান। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পৃথিবীর প্রতিটি ঘূর্ণনই নির্দিষ্ট নয়। পৃথিবীর ঘূর্ণনপ্রক্রিয়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে প্রভাবিত হয়- যেমন চাঁদ ও সূর্যের মহাকর্ষীয় টান, আবহাওয়ার পরিবর্তন, মেরু অঞ্চলের বরফ গলা এবং পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তরল গঠন ইত্যাদি।
ফলে প্রতিটি দিনের দৈর্ঘ্য প্রায়ই ২৪ ঘণ্টার চেয়ে একটু কম বা বেশি হয়, যদিও তা মিলিসেকেন্ডের পার্থক্য। কিন্তু বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, এই সামান্য পরিবর্তন ভবিষ্যতে বড়সড় সময়সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি করতে পারে।
ইতিহাস বদল
২০২৪ সালের ৫ জুলাই, পৃথিবীর একটি ঘূর্ণন সম্পন্ন হতে সময় নিয়েছে ২৪ ঘণ্টার চেয়ে ১.৬৬ মিলিসেকেন্ড কম। এটিই ছিল আধুনিক ইতিহাসে রেকর্ডকৃত সবচেয়ে ছোট দিন।
এ বছর, ৫ আগস্ট, ৯ জুলাই ও ২২ জুলাই- এই তিনটি দিনও স্বাভাবিকের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে ছোট ছিল বলে আগেই জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক পৃথিবী ঘূর্ণন ও রেফারেন্স সিস্টেম পরিষেবা (IERS)। এর মধ্যে ৫ আগস্টের দিনটি ২৪ ঘণ্টার চেয়ে প্রায় ১.৫১ মিলিসেকেন্ড কম দীর্ঘ ছিল।
‘লিপ সেকেন্ড’ নিয়ে চিন্তা
১৯৭২ সাল থেকে, পৃথিবীর ঘূর্ণন ধীর হওয়ার কারণে সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে ‘লিপ সেকেন্ড’ যুক্ত করা হতো। এখন পর্যন্ত ২৭টি লিপ সেকেন্ড যুক্ত করা হয়েছে। তবে বর্তমানে পৃথিবী দ্রুত ঘুরতে থাকায় এই সেকেন্ড ‘বাদ’ দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে- যা আগে কখনো ঘটেনি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তবে ২০২৯ সালের মধ্যেই প্রথমবারের মতো এক সেকেন্ড সময় থেকে বাদ দিতে হতে পারে, যাকে বলা হচ্ছে নেতিবাচক লিপ সেকেন্ড। এটা প্রযুক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক জটিলতা তৈরি করতে পারে, এমনকি ‘ওয়াইটুকে’ সমস্যার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
প্রযুক্তি ঝুঁকিতে
সময় নির্ভুলভাবে নির্ধারণের জন্য যে পারমাণবিক ঘড়ি ব্যবহার করা হয়, তা ব্যবহার হয় স্যাটেলাইট, মোবাইল ফোন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ সরবরাহ এমনকি বৈমানিক নিয়ন্ত্রণেও। এতদিন এই ঘড়িগুলোর সঙ্গে ‘লিপ সেকেন্ড’ দিয়ে সামঞ্জস্য রাখা হতো। কিন্তু যদি এক সেকেন্ড বাদ দিতে হয়, তবে বেশির ভাগ প্রযুক্তি ব্যবস্থাই সেই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত নয়। নেতিবাচক লিপ সেকেন্ড আগে কখনো ঘটেনি তাই এটি নিয়ে উদ্বেগ আরও বাড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকাও রয়েছে
গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকার বিশাল বরফভাণ্ডার গলে সমুদ্রপৃষ্ঠে মিশে যাওয়ায় পৃথিবীর ভরকেন্দ্র ও ঘূর্ণন অক্ষের পরিবর্তন ঘটছে, যা পৃথিবীর ঘূর্ণন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই বরফ না গলত, তবে পৃথিবী এখনো অধিক দ্রুতগতিতে ঘুরত এবং নেতিবাচক ‘লিপ সেকেন্ড’ হয়তো এরই মধ্যে প্রয়োজন হয়ে পড়ত।
জার্মানির এক গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, শতাব্দীর শেষে এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হয়তো চাঁদের মহাকর্ষীয় প্রভাবকেও ছাপিয়ে যেতে পারে।
সতর্কতা প্রয়োজন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদিও এই পরিবর্তন এখনই আমাদের জীবনযাত্রায় তেমন প্রভাব ফেলছে না, তবে ভবিষ্যতের জন্য সময়ানুগ প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি এবং এর ওঠানামা এখনো স্বাভাবিক সীমার মধ্যে রয়েছে, কিন্তু এটি যেকোনো সময় প্রযুক্তিগত বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে।