প্রিয় নেতা, প্রিয় অভিভাবক, জনদরদী, স্যার ইত্যাদি খেতাবই বেশি পছন্দ করতেন কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনের সাবেক এলজিআরডিমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তৈরি করেন একক রাজত্ব। মন্ত্রীর এই রাজত্বে ক্ষমতার প্রচণ্ড দাপট ছিল তার শ্যালক লাকসাম উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মহব্বত আলীর।
২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে লাকসাম মনোহরগঞ্জে রাজত্ব শুরু করেন তারা। দিন যত গেছে তাদের ‘রাজত্ব’ ততই বেড়েছে। গত ১৬ বছর শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, নিজের দলের বিরোধীদেরও রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা করে ফেলেন দুলাভাই-শ্যালক। তাদের মতের বিরোধ হলেই করতেন বিভিন্নভাবে হয়রানি। ভয়ে মুখ খুলতেন না তাদের দলের লোকজন। নির্বাচন ছাড়াই গত দুই উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদে টাকার বিনিময়ে চেয়ারম্যান-মেম্বার পদে বসান তাদের পছন্দের লোকজনকে। কেউ নির্বাচন করতে চাইলে দিতেন হুমকি।
স্থানীয়রা জানান, গত ১৫ বছরে লাকসাম-মনোহরগঞ্জ জুড়ে শ্যালক মহাব্বত আলী ও ভাতিজা আমিরুল ইসলাম এবং সমন্বয়ক নামের ট্যাগ লাগানো এক সময়ের পাসপোর্ট অফিসের দালাল কামাল হোসেনকে নিয়ে একক রাজত্ব তৈরি করেন সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। কুমিল্লা-৯ আসনের এমপি হলেও পরপর দুইবার মন্ত্রিত্ব পাওয়ায় পুরো জেলাতে তাজুল ইসলামের কথাই ছিল শেষ কথা। শুধু তাই নয়, কয়েক মাস আগে শেষ হওয়া ভোটবিহীন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও ছিল তাজুল ইসলাম এবং তার বাহিনীর আধিপত্য।
জানা যায়, ২০০৮ সাল থেকে টানা চারবার এমপি ও দুইবার মন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে তাজুল ইসলাম ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন তার ক্যাডার বাহিনী। দমন-নিপীড়ন শুরু করেন পুরো সংসদীয় আসনে। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তাজুল ইসলামের প্রভাব ছিল না। একক শাসনে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে তৈরি করেন তার শ্যালক মহাব্বত আলীকে। জিম্মি করা হয় সরকারি-বেসরকারি অফিসের নিরীহ অফিসার, রেজিস্ট্রি অফিস, ভূমি অফিস, বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিকদের। রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে দখল করে নেন সরকারি বিভিন্ন পুকুর ও জলাশয়। সেগুলো ভরাট করে বিক্রিও করে দেন দ্রুত।
দীর্ঘদিনের ক্ষমতার প্রভাবে তাজুল ইসলাম শ্যালক মহব্বত আলীকে দিয়ে নামে-বেনামে, দেশে-বিদেশে গড়েছেন বিপুল সম্পদ। এক কথায় বলতে গেলে গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে তাজুল ইসলামই ছিলেন লাকসাম মনোহরগঞ্জের ‘একমাত্র রাজা’। গত সোমবার ছাত্রজনতার গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যায় ভারতে। বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, হাসিনার পদত্যাগ করার আগেই দেশ থেকে পালিয়ে যান তাজুল ইসলাম। ইতোমধ্যে এলাকা থেকে পালিয়ে গেছেন তার শ্যালক মহাব্বত আলী ও তাদের অনুসারীরা। এদিকে, গত সোমবার সেনাপ্রধানের বক্তৃতায় শেখ হাসিনার পদত্যাগের কথা শুনেই রাস্তায় নেমে আসে লাকসাম মনোহরগঞ্জের ছাত্রজনতা। একই সঙ্গে অবসান ঘটে তাজুল ইসলাম ও তার শ্যালকের রাজত্বেরও। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা তাজুল ও মহাব্বতের লাকসাম এবং পোমগাঁওয়ের বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। অগ্নিসংযোগ করা হয় পুরো বাড়িতে।
এ সময় বিক্ষুব্ধরা বলেন, ফেরাউন থেকে আল্লাহ আমাদের মুক্ত করেছেন। জালিম তাজু ও তার বাহিনীর হাত থেকে লাকসাম-মনোহরগঞ্জ মুক্ত হয়েছে। প্রায় একই সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাকসাম-মনোহরগঞ্জের সাধারণ মানুষ তাজুল ইসলাম, শ্যালক মহাব্বত আলী, ভাতিজা আমিরুল ইসলাম ও সমন্বয়ক কামাল হোসেনকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য পোস্ট করতে শুরু করেন। তারা লিখেন, কোথায় গেল প্রিয় অভিভাবক, প্রিয় নেতা!
লাকসাম নশরতপুর এলাকার মনির হোসেন বলেন, জালিমের বাড়িটা কিভাবে পুড়ছে, সেটা দেখতে আসছি। লাকসামের মানুষকে বছরের পর বছর ধরে লুটে খেয়েছে তাজু ও তার শ্যালক মহাব্বত আলী। তাদের কাছে মানুষ জিম্মি ছিল। আমাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে।
জনি নামের আরেক তরুণ বলেন, তাজুল ইসলাম অন্য এমপিদের মতো ঢাকা-চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও বিদেশে শ্যালক মহাব্বত আলীর মাধ্যমে বিপুল সম্পদ গড়েছেন। দুদকের উচিত এগুলো তদন্ত করে বের করা। আমাদের তারা এতদিন জিম্মি করে রেখেছিল। তাদের রাজত্বের অবসান হয়েছে, এতেই আমরা মহাখুশি।