ঢাকা শুক্রবার, ১৮ জুলাই, ২০২৫

বাবার কোলেই মেয়ের মৃত্যু, মেহেরুন ছিলেন সংগ্রামী নারী

ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ১৭, ২০২৫, ০২:১৯ পিএম
শহীদ মেহেরুন নেছা তানহা (২২)। ছবি- সংগৃহীত

রাজধানীর মিরপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ফ্যাসিস্টের গুলিতে নিহত হন অনার্সপড়ুয়া শিক্ষার্থী মেহেরুন নেছা তানহা (২২)। স্থানীয় একটি শোরুমে চাকরি করে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতেন এই মেধাবী শিক্ষার্থী।

জানা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট রাতে নিজের ঘরে জানালার ফাঁক দিয়ে ছোড়া গুলিতে তিনি প্রাণ হারান।

পরিবারের দাবি, তার কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না, তবে মামাতো ভাই রাব্বির হত্যাকাণ্ডের পর থেকে তিনি আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন।

বাবার কোলেই মেয়ের মৃত্যু

তানহার বাবা মোশাররফ হোসেন একজন গাড়িচালক। মাসিক ১৬ হাজার টাকার আয়েই চলত সংসার।

তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি অনেক বলেছিলাম, মিছিলে যাস না মা। ৫ আগস্টও গেল গণভবনের সামনে, ফিরেও এলো। কিন্তু এরপর কী হলো… রুমে দাঁড়িয়ে মাথার চুল বাঁধছিল, ঠিক তখনই গুলি লাগে বুকের মাঝে। আমি দৌড়ে আসি, কোলে নেই, পানি খাওয়াই। মা ডাকছি, কিন্তু আমার মা আর চোখ খোলেনি।’

গত বছরের ১৯ জুলাই জুমার নামাজের পর মিরপুর মাজার রোডে নিহত হন তানহার মামাতো ভাই আকরাম খান রাব্বি।

পরিবারের দাবি, রাব্বির হাতে জায়নামাজ থাকলেও তাকে পেছন থেকে গুলি করা হয়। মৃত্যুর পর তিন দিন ধরে মরদেহ আটকে রাখা হয় হাসপাতালের মর্গে।

এই ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তানহা। শুরু করেন প্ল্যাকার্ড হাতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ। তার পোস্টার লেখা ছিল, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।’

তানহার মা আছমা আক্তার বলেন, ‘মেয়ে আমার জন্য গণভবন থেকে ফুল এনেছিল। বলেছিল, মা দেখো তোমার জন্য ফুল এনেছি। পানি খেয়ে রুমে যায়। ভাইকে ফোন দেয়, বলে নতুন বাজারে গোলাগুলি হচ্ছে, পেছনের রাস্তায় আয়। কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম মেয়ে আমার মেঝেতে পড়ে গেল। বুক, মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।’

৫ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টার দিকে মেহেরুন নেছা তানহাকে পূর্ব বাইশটেক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তানহার মা এখনো নিজের হাতে আনা সেই শুকনো ফুলগুলো যত্ন করে রেখেছেন।

‘ও আর কোনোদিন ফিরবে না। আমি ভুল করে এখনো খেতে বসে বলি, ‘তানহা আয় খেতে।’ তারপর মনে পড়ে- তানহা তো আর আসবে না।’

তানহার বাবা মোশাররফ হোসেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪০ জনের নামে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি বিচার চাই। আমি চাই, যারা নিরপরাধ ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের শাস্তি হোক। রাষ্ট্র যেন এই শহিদদের স্বীকৃতি দেয়।’

তানহার মামা ফারুক খান বলেন, ‘আমার ছেলে রাব্বি শহিদ হওয়ার পর তানহাকে আমাদের বাসায় রাখছিলাম। ওইদিন সকালে নিজের বাসায় ফিরেছিল। যদি না আসত, হয়তো ওকে হারাতে হতো না।’

মোশাররফ হোসেন জানান, ‘জুলাই ফাউন্ডেশন’ থেকে ৫ লাখ ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা সহযোগিতা পেয়েছেন।’

তবে তিনি বলেন, ‘আমি বেশি কিছু চাই না। আমি চাই, আমার ছেলের জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করা হোক। বয়স হয়ে গেছে, আর কত চালাতে পারব সংসার?’

তানহার মা বলেন, ‘মেয়েটা পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করবে, আমরা বিয়ে দেব- এই স্বপ্ন ছিল। সে প্রতিদিন খেটে সংসার চালাত, নিজের পড়াশোনা করত। আজ সব শেষ।’