পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের দেওয়া এক জবানবন্দিতে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ-আন্দোলন, গুম, গোপন বন্দিশালা, এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে বিস্ফোরক তথ্য উঠে এসেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি মামলায় রাজসাক্ষী হিসেবে দেওয়া পাঁচ পৃষ্ঠার এ জবানবন্দিতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা দিক তুলে ধরা হয়। বর্তমানে কারাগারে থাকা সাবেক এই আইজিপির জবানবন্দির একটি অনুলিপি সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
সাবেক আইজিপি দাবি করেন, গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন প্রধান হারুন অর রশিদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের গভীর সম্পর্ক ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে ‘জিন’ নামে ডাকতেন এবং সরকারের ‘ডান হাত’ মনে করতেন। হারুনকে তিনি রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত কার্যকর কর্মকর্তা হিসেবেও বর্ণনা করেন।
মামুনের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলন দমন করতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো হয়। প্রতিরাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক হতো, যেখানে আন্দোলন-প্রবণ এলাকাগুলোকে ভাগ করে ‘ব্লক রেইড’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তিনি দাবি করেন, শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ অস্ত্র ব্যবহারে ‘অতি উৎসাহী’ ছিলেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ১৮ জুলাই হাবিবুর রহমান প্রকাশ্যে চায়নিজ রাইফেল দিয়ে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন বলে দাবি করেন মামুন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা নিয়েও সাবেক আইজিপির বক্তব্য রয়েছে। তিনি বলেন, পুলিশ সেখানে কার্যকর ভূমিকা নেয়নি এবং রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশেই ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ওই হামলা চালায়। ছাত্রলীগের তৎকালীন কার্যক্রমে সরাসরি নির্দেশ দেন ওবায়দুল কাদের ও জাহাঙ্গীর কবির নানক।
১৯ জুলাই থেকে শুরু করে আন্দোলন দমনে প্রতিরাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় কোর কমিটির বৈঠক হতো। তাতে উপস্থিত থাকতেন স্বরাষ্ট্র সচিব, ডিএমপি কমিশনার, র্যাবের ডিজি, ডিবিপ্রধান, এনএসআই ও ডিজিএফআই প্রধানসহ নিরাপত্তা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা। সেখানেই আন্দোলনকারীদের সমন্বয়কারীদের আটক ও নির্যাতনের সিদ্ধান্ত হয়, যা বাস্তবায়ন করে ডিবি ও ডিজিএফআই।
৪ আগস্ট, সরকার পতনের আগের দিন শেখ হাসিনা দুই দফা বৈঠক করেন। প্রথম বৈঠকে ছিলেন আইনমন্ত্রী ও তিন বাহিনীর প্রধানরা। দ্বিতীয় বৈঠকে ছিলেন শেখ রেহানাসহ নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষকর্তারা। সেখানে আন্দোলন দমনের কৌশল ও ফোর্স মোতায়েন নিয়ে আলোচনা হয়।
৫ আগস্ট সেনাবাহিনী আন্দোলনকারীদের ঢাকায় প্রবেশে বাধা না দেওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় বলে দাবি মামুনের। তিনি বলেন, দুপুরের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারেন সরকার পতনের সময় ঘনিয়ে এসেছে।
জবানবন্দিতে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের কথাও উল্লেখ করেছেন মামুন। তিনি বলেন, তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীর পরামর্শে রাতেই ব্যালট বাক্সে ৫০ শতাংশ ভোট ভরে রাখা হয়। সরকারপক্ষীয় প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ে পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়।
২০২০-২০২২ মেয়াদে র্যাবের ডিজি থাকা অবস্থায় অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে মামুন বলেন, র্যাব সদর দপ্তরে টিএফআই সেল নামের একটি গোপন ইউনিট ছিল, যেখানে সরকারবিরোধী ব্যক্তিদের আটক, নির্যাতন ও গুম করা হতো। এসব কর্মকাণ্ড ছিল ‘সংগঠনগত সংস্কৃতি’। তিনি দাবি করেন, গুম বা ‘ক্রসফায়ার’-এর নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কিংবা নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের পক্ষ থেকে আসত।
সবশেষে সাবেক আইজিপি লিখিতভাবে ক্ষমা চেয়ে বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, গুলি, নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের ঘটনায় আমি লজ্জিত ও অনুতপ্ত। আমি জনগণের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী এবং আমার ভূমিকার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্যই এই জবানবন্দি প্রদান করেছি।

 
                             
                                    


 সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন