বুধবার (২০ আগস্ট) ছিল বিশ্ব মশা দিবস। ১৯৩০ সাল থেকে এ দিনটিকে পালন করা হয়ে আসছে বিশ্বব্যাপী, মশাবাহিত রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে। এবারের প্রতিপাদ্য- ‘এখনো জানার অনেক বাকি’ - এই ছোট্ট কিন্তু মরণঘাতী পতঙ্গের ব্যাপারে আমাদের অজানা অনেক দিকের ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর মশাবাহিত রোগে মারা যান প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ, যা পৃথিবীর যেকোনো প্রাণীর তুলনায় সর্বোচ্চ। শুধু ম্যালেরিয়াতেই মারা যায় প্রায় ৫ লাখ মানুষ। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার, জিকা ভাইরাসসহ অসংখ্য রোগের মূল বাহক এই ক্ষুদ্র মশাই।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহ পরিস্থিতি
বাংলাদেশে বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। শুধু ২০১৯ সালেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন এবং মারা যান ১৭৯ জন। চলতি বছর এই সংখ্যা এরই মধ্যে ছাড়িয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন ও নগরায়নের বিশৃঙ্খলা, বিশেষ করে অপরিষ্কার ছাদ, ড্রেন, নর্দমা- এসবই মশার জন্য আদর্শ প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করেছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ এখন ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে।
মশা: ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর হত্যাকারী
একটি গবেষণা অনুযায়ী, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রাণী হচ্ছে মশা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মানুষ নিজেই। মশার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ইতিহাসের যেকোনো যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে বেশি।
গবেষকরা বলছেন, মশা এমন একটি প্রাণী, যার একটি কামড়েই লুকিয়ে থাকতে পারে মারাত্মক ভাইরাস বা পরজীবী।
বাংলাদেশে চিহ্নিত ১২৬ প্রজাতির মশা
গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১২৬টি মশার প্রজাতি চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকাতেই পাওয়া যায় ১৬ প্রজাতি। বাংলাদেশে যে মশাবাহিত রোগগুলো বেশি দেখা যায়, সেগুলো হলো- ডেঙ্গু (এডিস ইজিপ্টি ও অ্যালবোপিকটাস মশা), চিকুনগুনিয়া (এডিস মশা), ম্যালেরিয়া (অ্যানোফিলিস মশা), ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগ (কিউলেক্স ও ম্যানসোনিয়া মশা), জাপানিজ এনকেফালাইটিস (কিউলেক্স মশা)।
চিকুনগুনিয়া ও ম্যালেরিয়ার চিত্র
২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়। ২০১৬-১৭ সালে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
অন্যদিকে, ম্যালেরিয়া মূলত পার্বত্য জেলা ও সীমান্ত অঞ্চলের ১৩টি জেলায় বেশি দেখা যায়। ২০০৮ সালে ৮৪ হাজার ৬৯০ জন আক্রান্ত হন এবং ১৫৪ জন মারা যান। ২০২২ সালে এই সংখ্যা নেমে আসে ১৮ হাজার ১৯৫-এ, তবে এ বছর আবারও সংক্রমণ বেড়েছে।
ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনকেফালাইটিসের উপস্থিতি
গোদ রোগ বা ফাইলেরিয়া একসময় বাংলাদেশের ৩৪টি জেলায় প্রভাব বিস্তার করলেও, সরকার পরিচালিত ফাইলেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। জাপানিজ এনকেফালাইটিস নিয়ে দেশে এখনও পর্যাপ্ত গবেষণা না থাকলেও, এটি কিউলেক্স মশার মাধ্যমে ছড়ায় বলে প্রমাণ রয়েছে।
মশার কামড় নিয়ে গবেষণা কী বলছে?
যুক্তরাষ্ট্রের রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের ত্বকে কার্বক্সিলিক অ্যাসিড বেশি থাকে, তারা মশার কাছে অধিক আকর্ষণীয়। এছাড়া গর্ভবতী নারীরা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করেন, যা মশাকে আকৃষ্ট করে। এসবই মশার ‘টার্গেট’ নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
সব অঞ্চলে মশা থাকে না কেন?
পৃথিবীর কিছু অঞ্চলে- যেমন আইসল্যান্ড বা অ্যান্টার্কটিকা- মশা একেবারেই নেই। কারণ, সেখানে প্রজননের জন্য প্রয়োজনীয় উষ্ণতা ও জমে থাকা পানি নেই। এসব অঞ্চলের জলবায়ু মশার বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত নয়।
করণীয় কী?
মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতা আনতে হলে বিজ্ঞানভিত্তিক ও সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা, গবেষণা, ওষুধ উদ্ভাবন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশ সংরক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা জরুরি। শুধু ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন।
বিশ্বের সবচেয়ে ছোট এই ঘাতক প্রাণীকে মোকাবিলায় আমাদের করণীয় আর অবহেলা করার সুযোগ নেই- কারণ, এটি আর শুধু স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি জীবন-মরণ ও টেকসই উন্নয়নের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন